X

অন্তরালের গল্প || পর্ব-১

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৮ জুলাই ২০২০, শনিবার

ডা. তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী 
কমান্ড্যান্ট, সিএমএইচ ঢাকা

আজকের হঠাৎ বৃষ্টি মনে করিয়ে দিল সেদিন রাতের ঘটনা। গায়ে কাটা দিয়ে ওঠার মতো একুশটি মিনিট। প্রায় দরদর করে ঘাম ঝরছিল আমাদের সবার, শিরঁঁদাড়া দিয়ে বয়ে গিয়েছিল শীতল স্রোত।

২০ মে ২০২০ তারিখ, রাত প্রায় তিনটা বাজে। ঘন্টা খানেক আগে মাত্র ফেরত এসেছি, যে হাসপাতালে কাজ করি সেখান থেকে। যথানিয়মে বাসার সবাই ঘুমিয়ে ছিল সেহেরির জন্য উঠবে বলে। রাতের খাবার টেবিলে ঢাকা দেওয়া। নিয়মে পরিনত হয়েছে তা। ঠান্ডা খাবার আর গরম করতে ইচ্ছে করছিল না। কোনমতে নাকে মুখে গুজে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলে শান্তি। ক্লান্ত শরীর একটু বিশ্রাম দাবী করে। কিন্তু ঘুম তো সূদূর পরাহত! কি যে হয়েছে এই সময়টাতে? শরীর-মন দুটোই ক্লান্ত, কিন্তু ঘুম আসবে না।

হঠাৎ সেলফোন বেজে উঠল। আতঙ্কিত কর্তব্যরত চিকিৎসকের গলা, সরাসরি আমাকেই ফোন করেছে, বিদ্যুৎ নেই ৫ মিনিট ধরে করোনা আইসিইউতে। চমকে ভেসে উঠলো কে কে আছেন আইসিইউতে। যন্ত্রনাকাতর, শ্বাসকষ্ট পাওয়া মুখ গুলো ভেসে উঠলো। ক’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও আছেন।

৫ মিনিট বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার কোন কারণ নেই। বিশেষতঃ আইসিইউতে। সাথে সাথে জেনারেটর চালু হবার কথা! নিশ্চয়ই কোন বড় সমস্যা হয়েছে!

কোনরকমে দু’পায়ে প্যান্ট গলিয়ে, জামা হাতে, গাড়ির চাবি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে হাসপাতাল ইঞ্জিনিয়ার কে ফোনে খবর দিলাম। সিনিয়র ইন্টেসিভিস্ট কে একবারেই ফোনে পেয়ে গেলাম। কেউই ঘুমায়নি অথবা অধিক ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছিল না কারো। অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার শুধু করোনা আইসিইউ এলাকায়।

সমস্ত কর্মীদের একসাথে করে কাজে লেগে গেল সবাই, নেতৃত্বে ইন্টেন্সিভিস্ট। সবার হাতে আম্বু ব্যাগ নিয়ে রেডি। যদি ভেন্টিলেটর গুলির ব্যাটারি ব্যাকআপ শেষ হয়ে যায়, তবে সবাই আম্বু রিসাসিটেশন করবে।

ইঞ্জিনিয়ার চলে এসেছে মোটর বাইক নিয়ে।
তার দলবল সহ লেগে গেছে সমস্যা খোঁজ করতে। কিছুক্ষণ পর পরই উদ্বিগ্নতার সাথে খবর নিচ্ছি, পাওয়া গেল? কতক্ষন লাগবে আর?

অন্ধকার আইসিইউতে সবার মোবাইল আর মনিটরের ডিসপ্লের আলোতে কাজ চলছে। ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে কক্ষ। স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, যিনি এখানে ভর্তি আছেন, তার কন্যা চলে এসেছে বাবার কাছে। বাবাকে সান্ত্বনা আর সাহস যোগাচ্ছে, ভয় নেই বাবা, কিচ্ছু হবে না। মুখগুলো ক্রমান্বয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করেছে।  বৃষ্টির প্রকোপও যেন বেড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করে তিরতির করে আলো চলে এসে আবার চলে গেল। আশার সঞ্চার হলো যেন সবার মধ্যে।

ইঞ্জিনিয়ার ফোনে জানাল হাসপাতালের প্রবেশ মুখে যেসব তাবু লাগানো হয়েছে ট্রায়াজ এর জন্য, সেখানকার বিদ্যুৎ লাইনে সমস্যা। একই সাথে জেনারেটর এর যে সুইচ অটো চালু হয় সেটিও সমস্যা দিচ্ছে। যেকারণে জেনারেটর চালু হয়নি। উদ্বিগ্ন স্বরে ও জিজ্ঞাসা করলো, “কতক্ষন সময় পাওয়া যাবে আর?”

ঠিক একুশ মিনিট পর বিদ্যুৎ ঠিক হলো।
বিদ্যুৎ এর আলোতে হাসপাতাল কর্মীদের ঘর্মাক্ত মুখ গুলো আরও উজ্জ্বল দেখাল। কর্তব্যবোধ আর হ্রদয়ের উষ্ণতায় তা আরো উজ্জ্বল হয়েছে।

বাড়ি আসার পর কর্তী ঘোষণা করলেন, “তোমার জামা উল্টো করে পরে আছো, আর ঠিক করার প্রয়োজন নেই। একটু পরেই তো হাসপাতালে দৌড়াবে!”

Sarif Sahriar:
Related Post