X
    Categories: গল্প

হাসপাতালের নাম বাংলাদেশ এবং একজন বীরপ্রতীক এঁর গল্প ……

লেখক – ক্যাপ্টেন শামস
১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ ঈসমাইল মিয়া এবং হাকিমুন নেসার ঘর আলো করে জন্ম নেন এক কন্যা সন্তান। এই সন্তান পরে আকাশের তারা হয়েই জ্বলজ্বল করবেন এই ভেবেই হয়তো পিতা নাম রাখেন সিতারা, সিতারা বেগম। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় সিতারার শৈশব কাটে কিশোরগঞ্জে। বড় ভাই আর্মিতে যোগ দেওয়াতে তার মনের কোনেও উঁকি দিয়েছিলো আর্মি হবার স্বপ্ন। তবে হলিক্রস কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাসের পরপর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। চিকিতসক হিসেবে ইন্টার্ন শেষ করার পর মনের সুপ্ত বাসনা পূরন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনামেডিকেলে যোগদান করে। চিকিৎসক সিতারা হয়ে যান আর্মির লেফটোন্যান্ট। বড় ভাই হায়দার তখন আর্মির মেজর।

১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলিতে লেফটোন্যান্ট সিতারা কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। বড় ভাই মেজর হায়দার পিন্ডির চেরাট থেকে বদলি হয়ে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ানে চলে আসেন। এই সময়ে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার আন্দোলন। দুই ভাইবোনই তখন ছুটিতে ছিলেন। মেজর হায়দার আর কর্মস্থলে যোগদান না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ছোটবোনকে আর কর্মস্থলে ফিরে না যাবার পরামর্শ দিয়ে যান। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বারবার কাজে যোগদানের চিঠি আসলে বাবা মোহাম্মদ ঈসমাইল উত্তর লিখে দিতেন, শী ইজ সিক।

কিশোরগঞ্জে কিছুদিন থাকার পর মিলিটারি আসার মাত্র দুদিন আগে নানার বাড়ি হোসেনপুর পালিয়ে যান সপরিবারে। এর মধ্যেই সিতারার বাবা এবং বড় ভাইয়ের ধরিয়ে দেবার পুরষ্কার ১০ হাজার টাকা ঘোষনা হয়ে গেছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে টানা আট দশদিন নৌকায় চেপে সিতারা পাড়ি জমান মেঘালয়ে। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে সিতারা যোগদান করেন বাংলাদেশ হাসপাতালে।

বাংলাদেশ হাসপাতাল প্রথমে স্থাপিত হয় সীমান্তসংলগ্ন ভারতের সোনামুড়ায়। পরে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তা স্থানান্তর করা হয় আগরতলার সন্নিকটে বিশ্রামগঞ্জে। সেখানে হাসপাতালটির ঘরের কাঠামো ছিল বাঁশ দিয়ে তৈরি। চারদিকে বাঁশের বেড়া, মাটির ভিত এবং বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে বিছানা। একেকটি ঘরে ৪০-৫০টি বিছানা। অপারেশন রুম প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। ওপর-নিচ চারদিকে প্লাস্টিক। ভেন্টিলেশনের জন্য কয়েক স্থানে ছোট ছোট ফোঁকর। বেশির ভাগ সময় দিনের বেলাতেই এখানে অপারেশন হতো। রাতে জরুরি হলে হারিকেন বা টর্চলাইট জ্বালিয়ে অপারেশন হতো। শেষদিকে অবশ্য জেনারেটর ছিল।

মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র কর্মরত ছিলেন হাসপাতালে। এছাড়া ছিলেন ডাঃ জাফরউল্লাহ, ডাঃ কিরণ সরকার, ডাঃ ফারুক, ডাঃ নাজিমুদ্দিন, ডাঃ মোর্শেদ। দশবারো জন ভলান্টিয়ার এসেছিলেন আর্মি থেকে। তবে কেউই সুবেদারের উপরে ছিলেন না। ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেতে হতো আগরতলা বা উদয়পুরে।

লেফটোন্যান্ট সিতারা অগাস্টের শুরুতে বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন। পরে হাসপাতালের সিও (কমান্ডিং অফিসার) কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁকে সিও হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর সামরিক হাসপাতাল যেভাবে চলে, সেভাবে এই হাসপাতাল পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশ হাসপাতালে অসাধ্য সাধনের মতো ছিল লেফটোন্যান্ট সিতারার কাজ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে আহত মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিনই এই হাসপাতালে পাঠানো হতো। কেউ শেলের স্প্রীন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত, কেউ গুলিবিদ্ধ। যতোই আহত হন না কেন মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার সেবায় চাঙ্গা হয়ে উঠতেন। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাও এখানে হতো। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের স্বল্পতা সত্ত্বেও দুইজন ডায়রিয়া-ডিসেন্ট্রিতে মৃত্যু ছাড়া আর কেউ এই হাসপাতালে মারা যাননি। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা যে অবদান রেখেছেন তা স্মরণীয়।

ভারতীয় আর্মির অনেক সৈন্যও এখানে চিকিৎসার জন্য আসতেন। লেফটোন্যান্ট সিতারাও মাঝে মাঝে আগরতলার IA Hospital এ চিকিৎসা প্রদানের জন্য যেতেন। একবার ভারতীয় সেনা বোঝাই এক ট্রাক উলটে গেছিলো। আহতদের বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। জেনারেল রব এর হেলিকপ্টারে গুলি লাগলে আহত জেনারেল বাংলাদেশ হাসপাতল থেকে চিকিৎসা গ্রহন করেন।

১৯৭১ এর শেষদিকে জেনারেল ওসমানির নির্দেশে লেফটোন্যান্ট সিতারার পদন্নতি ঘটে। সিতারা বেগম হন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ হাসপাতালে মেধা, শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ক্যাপ্টেন সিতারা বেগমকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বীর প্রতীক

মুক্তিযুদ্ধে একজন নারী, একজন চিকিৎসক এবং একজন আর্মি অফিসার হিসেবে সিতারা বেগমের অবদান সকলের জন্য আদর্শ হওয়া উচিৎ। তিনি শুধু ঘরে বসে থাকেননি, শুধু বুলি কপচাননি, নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গেছেন। নিজের কাজের ক্ষেত্র থেকে সহযোগিতা করেছেন স্বাধীনতা অর্জনে। আফসোস আজ এটুকুরই অভাব। আমরা নিজের কাজের ক্ষেত্র কোনটা তাই চিনিনা। একজন সিতারা বেগমের আজ খুব প্রয়োজন।

সূত্রঃ

১) মুক্তিযুদ্ধ : ডেটলাইন আগরতলা, হারুন হাবীব

২) উইকিপিডিয়া

৩) প্রথম আলো, তারিখ ১৩ জুন ২০১১

৪) ছবি কৃতজ্ঞতা : জন্মযুদ্ধ৭১, অমি রহমান পিয়াল

ডক্টরস ডেস্ক: bddoctorsplatform@gmail.com

View Comments (3)

Related Post