X

হাল ছেড়ো না বন্ধু, জীবন অমূল্য; তাকে বাঁচাতে হবে

সম্ভবত ২০০৯ এর ডিসেম্বর মাস। কোন এক অ্যাডমিশন ওটির রাতের ঘটনা। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ইউনিট ২ এর অ্যাডমিশন, আমি সেই ইউনিটের ইন্টার্ন চিকিৎসক।

রাত তখন প্রায় ১০ টা/১১ টা মনে হয়। অপারেশন থিয়েটারে কাজ করছিলাম আমরা কয়েকজন- সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শরীফ ভাই, আমি আর আমার বন্ধু ডা.জাহাঙ্গীর। সারাদিন-রাত ধরে আসতে থাকা ইমার্জেন্সী কেসগুলা করে শেষ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের উপর ছায়া হয়ে উপস্থিত তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ডা. নুরুদ্দীন স্যার। রাতের ইমার্জেন্সী ওটিতে স্যারকে পেয়ে কাজ করা আরো সহজ হয়ে গেল।

হঠাৎই ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসারের ফোন, একজন গুরুতর আহত রোগী পাঠাচ্ছি, একটু দ্রুত দেখেন, অবস্থা ভাল নয়। আমরা হাত দ্রুত চালাতে লাগলাম, বাইরে দারোয়ানকে বলে রাখা হল রোগীর ট্রলী ওটির প্রিপারেশন রুমে পৌছলেই আমাদের খবর দিতে।

ইতিমধ্যে আমার কাজ শেষ, রোগীও পৌছাল। ওটি খালি না থাকায় বাইরের রুমেই রোগী দেখতে গেলাম। রক্তে মাখামাখি একজন লোক, নিথর পড়ে আছে ট্রলীতে, বাইরে স্বজনরা আহাজারি করছে রোগী মরে গেছে ভেবে। পরীক্ষা করে দেখি পালস পাই না! ক্যারোটিডে দেখি হঠাৎ একটা দুটা করে করে আসে। নতুন ইন্টার্নী শুরু করেছি, শুরুতেই খুব খারাপ অবস্থার বেশ কয়েকজন রোগী মারা যেতে দেখেছি বলে কেন যেন এই রোগীর ব্যাপারেও সেই ধারনা হল, এই মানুষটাও বুঝি শেষ! আমি হাল ছেড়ে দিলাম প্রায়।

আমার রোগী দেখে আসার দেরী দেখে স্যার নিজেই এসে রোগীর পালস দেখে ট্রলী ধরে টান দিয়ে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছ কেন? রোগী নিয়ে আস ওটিতে জলদি!”

মৃতপ্রায় রোগী ওটিতে ঢুকল আর ওটিতে যেন মহাযুদ্ধ শুরু হল। ক্যানুলা করার উপায় নেই দেখে ভেনিসেকশন করলেন স্যার, ৩ টা হার্টম্যান লাগানো হল। চার হাত পায়ের কমপক্ষে ৫ টা হাড় ভাঙা ছিল তার, কয়েকটা ইন্সাইসজড উন্ড। দ্রুত স্যারের নেতৃত্বে আমরা কাজ শুরু করলাম। আমরা ক্ষত ম্যানেজম্যান্টে লেগে গেলাম, স্যার প্লাস্টার করতে লেগে গেলেন, ক্যাথেটার করা হল, সিস্টার আই ভি অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি দিতে লাগলেন, ওটি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্লাস্টার খুলে রেডি করছে আর স্যার যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে প্লাস্টার করতে লাগলেন। আমাদের ইমার্জেন্সী স্টক থেকে যা যা ছিল, সব দিতে লাগলাম।

ইতিমধ্যে রোগীর রক্তের গ্রুপ করা হল, রক্ত যোগাড় করতে বলা হল। জরুরী ভিত্তিতে সন্ধানী থেকে এক ব্যাগ রক্ত এনে চালু করলাম।

প্রায় দেড় ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রমের পর আমরা সংবিত ফিরে পেলাম লোকটির অস্পস্ট কন্ঠস্বর শুনে!!

নিজের কানকে যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!!

শেষ পর্যন্ত রোগীর কাছ থেকে তার কেন এই অবস্থা তার পুরো বিবরন শুনে তাকে পুরা ম্যানেজ করে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে পাঠানো হল। অবিশ্বাস নিয়ে রোগীর সাথে তার স্ত্রীর কথোপকথোন যেন আমাদের কাছে বেশ মজার ঘটনা মনে হচ্ছিল। বাড়িতে কবর খোড়ার জন্য বলা হয়েগিয়েছিল!!

কাজ শেষে স্যার যাবার সময় আমাদের বললেন, “শুধু তোমাদের জন্য এই রোগীকে আজ আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন। তোমাদের ধন্যবাদ।” ধন্যবাদ দিলেন সিস্টার ও ওটিবয় কেও!

আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম স্যারের টিমওয়ার্ক পরিচালনা দেখে। ওটির সীমিত চিকিৎসা উপকরনকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করে, ২ জন জুনিয়র চিকিৎসক, ১ জন নার্স ও ১ জন ওটিস্টাফকে সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়ে মৃতপ্রায় একজন মানুষকে বাচানোর মত কঠিন কাজ সেদিন সম্ভব হয়েছিল শুধু স্যারের এই হাল না ছাড়া টাইপ মনোভাবের জন্য।

স্যারের সাথে যোগাযোগ নেই অনেকদিন। স্যার আপনি ভাল থাকুন।

সেদিন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ওটিতে গভীর রাতের এই কয়েকঘন্টার যুদ্ধের খবর কোন পত্রিকায় আসেনি, কোন রেডিও টিভি সম্প্রচারও করেনি লাইভ।

আসার কথাও না। তাতে কি!

আমরা তো আর হলুদ মিডিয়া ও মিডিওকার মানুষজনের মত প্রচার আর পসারের লোভে আজরাইলের সাথে জান টানাটানিতে নামি না, নাম-পরিচয়হীন এক একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রাণপন লড়ি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ফুল ফুটিয়াছে, ইহাই ফুলের সাফল্য। যাহার ভাল লাগিল, সেই জিতিল।”

আমাদের কাজ আমরা করেই যাব ইনশাআল্লাহ, যখন যেখানে প্রয়োজন। যে এই কাজের মূল্য বুঝতে চায় মন থেকে, সেই বুঝবে।

সব কিছুর অন্তর্নিহিত অর্থ ঈশ্বর সকলকে বুঝার ক্ষমতা দেন না। যাদের এই ক্ষমতা নাই অনুগ্রহ করে চিকিৎসকের কাজে বাগড়া দিয়ে তাদের উপর চড়াও হবেন না। আখেরে তাতে লাভটা আপনারই হবে।

আর আমার সহকর্মীদের জন্য বার্তা রইল, “হাল ছেড়ো না বন্ধু,জীবন অমূল্য; তাকে বাঁচাতে হবে।”

সুন্দর ও নিরাপদ হোক সবার প্রতিটি দিন।

পাঠিয়েছেন: ডা. আহমেদ মেজবাহ অপু

Banaful:

View Comments (2)

Related Post