X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড ফোর্টি সেভেন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

প্রণব মুখার্জি মারা গেলেন। বাঙালির আগস্ট মাসের ট্রেনটা উনি মিস করলেন না। উসাইন বোল্ট করোনা পজিটিভ। বলা হতো মানুষ তার স্বপ্নকে চেজ করে। মানব ইতিহাসে একমাত্র ব্যতিক্রম উসাইন বোল্ট। তিনি এতো জোরে ছুটেন যে স্বপ্ন তাকে চেজ করে! সে তিনিও দৌড়ে করোনা থেকে বাঁচতে পারলেন না।

সেলিব্রেটিদের আক্রান্ত হবার সংবাদ খবরে আসে। সাধারণের আসে না। সাধারণ শুধু একটি সংখ্যা, স্ট্যাটিস্টিক্স। ইমার্জেন্সিতে এক ত্রিশ বছরের ছেলে এসেছিলো তার মাকে কোলে নিয়ে। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে নিথর নিস্পন্দ দেহ। এখন আর মৃতের কাছে যাই না, ইসিজি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করি। উনার ক্ষেত্রে গেলাম বহুদিন পর। শরীর তখনও গরম। মৃত্যুর ঘোষণা শোনে বাকিরা কাঁদছিল, ছেলেটা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। আবার ‘মা মা’ করে কোলে তুলে নিলো। ভাবছিলাম শ্মশান কত অদ্ভুত জায়গা! যতজন যায় সবসময় একজন কম ফেরত আসে।

ছবি – প্রতীকী

ওপিডিতে এক রোগী এসেছিলো। হার্ট এটাক সাথে ক্রিয়েটিনিন হাই। চেস্ট এক্সরেও খারাপ। বললাম- ঢাকা নিতে হবে। ভদ্রলোক অসহায় ভাবে তাকাচ্ছিলেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে ডাক্তারের কথা হজম করা। কখনো কখনো মরে যাওয়াই সহজ হয় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসার চেয়ে। ছোটবেলায় পড়েছিলাম পাকা হরিতকী খেলে নাকি ক্ষুধা তৃষ্ণা চিরতরে মরে যায়। কিন্তু এ পোড়ামুখী ফল এমনি যে কাঁচা অবস্থাতেই গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে। বিজ্ঞান কত এগুলো, এমন কী কিছু করা যায় না যেন হরিতকী না ঝড়ে!

ডিউটি চলছে ডিউটির নিয়মে। ভাল লাগে-লাগে না। এসব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কি প্রয়োজন বুঝি না। ইমার্জেন্সি আসলে রেফার করো। অথবা গিলে নাও চুপটি করে। হজম করতে পারো আর না পারো। মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছর, মানবসভ্যতার ৪.৫ বিলিয়ন। তুলনা করলে আমরা জাস্ট কয়েক সেকেন্ড বেঁচে থাকি। তার মাঝেই কত কাহিনী। মেয়ে মহিলারা আসেন বিচিত্র কমপ্লেন নিয়ে। সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে শুনতে হয়। শিখে গেছি- বেঁচে থাকা মানে নিরন্তর প্রতারণা।

আমি ডর্মিটরিতে যে রুমে উঠলাম আমার এক কলিগের রুম। বেচারা বাবা মা সমেত কোভিড পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। গতকাল ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে গেল। মৃত্যু যেন ছুঁয়ে চলে গেল। বেঁচে থাকার আনন্দ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখলেই পাওয়া যায়। একটু রাত হতেই পুরো হেলথ কমপ্লেক্স নীরব হয়ে পড়ে। শরতের রাত দেখি। চাঁদ দেখি। তুলোর মতো মেঘ দেখি। ছানিপড়া চোখের মতো কুয়াশা দেখি। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখ নাকি শীতের জন্ম হয়। পৌষে যৌবন, মাঘে বার্ধক্যের সূচনা। শীতের বুড়ী বুড়ী হয়েই জন্মে না। ষড়ঋতু শুধু বইপত্রেই আছে বাস্তবে নেই- এমন ধারণা পোষণ করতাম। এখন মনে হচ্ছে সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে অনেক কিছু পাওয়া যায়। ঋতুর পরিবর্তন বুঝতে পারি। মোবাইল, ঘড়ি, ক্যালেন্ডার সব উঠিয়ে দিলে বেশ হতো।

এ করোনা প্রিয়ডে প্রচুর বই পড়লাম। বই পড়ার অভ্যাসটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। প্রভাত মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, মনোজ বসু, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, হুমায়ূন আহমেদ, বনফুল, জরাসন্ধ, বিমান ধর। যেখানে যেমন পেয়েছি- পড়েছি। হয়তো আরও কিছুদিন। শুনছি আমাদের দ্বৈত ব্যবস্থা ডিউটি-কোয়ারেন্টাইন উঠে যাবে। প্রতিদিনের অফিস শুরু হবে। সর্বশেষ কোভিডের সাথে সম্পর্ক এটিই ছিল একমাত্র।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন ‘So fart, and if you must, fart often. But always fart without apology. Fart for freedom, fart for liberty, and fart proudly’. কী যে বলেছেন! বাঙলায় তর্জমা করা অসম্ভব! আমার লেখাগুলো এ ক্যাটাগরির। গর্বিতভাবে নিঃসরণ করছি যাচ্ছেতাই। আর কিছুদিন। অর্ডারটি শোনার পর থেকেই কোয়ারান্টাইনের দিনগুলোকে মিস করা শুরু করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে- ভালই ছিলাম সব খারাপ গুলোকে নিয়ে!!

Platform:
Related Post