X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড সিক্সটি ফাইভ

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

‘ডেথ সার্টিফিকেট’ এ কোনো কাব্যরস নেই। সেজন্য হয়তো মানুষ ভয় পায় না। নয়তো এ মৃত্যুই যদি কোন কবি সাহিত্যিক বর্ণনা করতেন- লোকে নিজের ভবিষ্যত দেখে কেঁপে কেঁপে উঠতো। এক ডেথ সার্টিফিকেট তিনবার লিখছি। কার্বন পেপার নেই। কখনোই থাকে না। মৃতের স্বজন এরমাঝেই লাশ দাফন নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু করে দিছে।

স্ট্রোক নিয়ে এসেছিল। নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম তারপর বাড়ি। অস্পষ্ট কী বলছিল বোঝা গেল না। সম্ভবত তখন এমন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিছেন যেখানে গ্রাম মহল্লা নেই!

ছবি – প্রতীকী

আজ সন্ধ্যার পর ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। তাই রোগী পত্তর কম। হাসপাতালে নাইট সবসময়ই প্যারাময়। কখন খারাপ হবে কেউ জানে না। চারপাশে তরল অন্ধকার। এ অন্ধকার জমাট বাঁধা নয়। অনবরত ব্যাঙের ডাক আলাদা স্বস্তি দেয়। কোথাও তো জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। মেঘ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘মেঘ কারো জীবনে ঝড় আনুক বা বৃষ্টি, সূর্য ডোবার নতুন রঙ তো অবশ্যই আনবে’। সূর্য উঠার আলাদা রঙ আছে কিনা দেখার জন্য আজ জেগে থাকতে হবে। গার্ড দেখে বললো ‘স্যার সাবধান, বৃষ্টি হইছে সাপ আছে…’। বললাম ‘সাপের কোনদিন উপকার করি নি। বাঙালি সাপ নুন না খেয়ে অপর বাঙালির অপকার করবে না। এ বাঙ্গালিত্বের স্বভাববিরুদ্ধ।’ গার্ড কী বুঝলো কে জানে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে গেল!

এখন তো পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে প্লেটো কেন তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের স্থান দেন নি। আমি তো মনে করি রাষ্ট্রে ছোটখাটো স্ট্যাটাস দাতাদেরও রাখা উচিত নয়। লিখতে বসেছিলাম কোভিড ডায়েরি, এখন আর ‘কো’-এরও অস্তিত্ব নেই! সর্বশেষ সংবাদঃ করোনা আর দশটি রোগের মতো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাংলাদেশে টিকে আছে। তার স্পেশাল মর্যাদা প্রায় কেড়ে নেয়া হয়েছে। কোভিড স্পেসিফিক হাসপাতাল গুলো সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও প্রতিদিন ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন করে মারা যাচ্ছেন। এখন যে বিপদে পড়বে বিপদ একা তার। উপরের নির্দেশে বাকিরা সবাই গায়ে ‘গু’ মেখে বসে থাকবে যেন যমরাজ কাছে না ঘেঁষে!!

আন্তর্জাতিক সংবাদঃ রাশিয়ান ভ্যাক্সিন নেয়ায় প্রতি সাতজনে একজনের সাইড ইফেক্ট প্রকট হয়েছে। আমেরিকান কোম্পানি মর্ডানা তাদের ট্রায়ালের ব্লু প্রিন্ট প্রকাশ করেছে। অক্সফোর্ড আবার ট্রায়াল শুরু করেছে। ভারতে প্রতিদিন এক লক্ষ করে আক্রান্ত হচ্ছে। টিকা আসতে আসতে সবাই প্রাকৃতিক ভাবে টিকা প্রাপ্ত হয়ে যাবে। মনেহচ্ছে পাড়াপাড়িতে কেউ লাভ করতে পারবে না!

ঢাকায় মেয়র সাহেবের নেতৃত্বে ‘কুকুর নিধন’ অভিযান চলছে। এক অভিনেত্রী তার বিরুদ্ধে রিট করে দিয়েছেন। মানুষ সবসময় সৌন্দর্য বা কাজ দিয়ে ‘প্রিয়’ হয় না, কখনো কখনো মেরুদণ্ড দিয়েই প্রিয় মানুষ হয়ে যায়। এ কুকুর হত্যার প্রতিবাদ যে যেখান থেকে করবে শ্রদ্ধা থাকবে। আরব্য রজনীর বুদ্ধিমান জেলেকে হত্যা করতে চাওয়া জ্বীনের গল্পে- জ্বীন চার শত বছর বোতল বন্দী হয়েছিল। আর এখানকার মানুষ তো সেদিন জানলো সে মানুষ; ‘মানবতা’ যে কয়শো বছর বোতলবন্দী হয়ে থাকবে আল্লায় জানে!

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ইন্দ্রের বাহন যেমন ঐরাবত, আমার বাহন তেমনি পদ্মা’। তিনি পদ্মানদীকে তার বাহন বানিয়েছিলেন। সত্যি গ্রাম-বাঙলার বর্ষা রূপ না দেখলে অর্ধেক বঙ্গ সাহিত্যই পাওয়া যায় না। এখন বাইকে বসে থাকি। ষাট-আশি-নব্বই কিলোমিটার গতিতে আসতে থাকে জলে ডোবা ধানক্ষেত, মাছ ধরার জাল, ছাতা নিয়ে বসে থাকা মৎস্যশিকারী, সাদা সাদা শাপলা ফুল, কচুরিপানা বন, রাস্তার পাশে বাজার, মনোহারি দোকান, কালভার্ট, নৌকা, দূরের মেঘ।

এটি আমনের মৌসুম। রোপা আমন ধান লাগাচ্ছে কৃষক। বোরোতে যেমন আয়োজন ছিল, আমনে এমন আয়োজন নেই। সব ক্ষেতে লাগানোও যাচ্ছে না। পানির নিচের জমি গুলো রেখে দেয়া হচ্ছে সরিষা, আলু, গমের জন্য। সেপ্টেম্বরের শেষে বন্যা হলে সব মার খাবে। বোরোতে অত ভেজাল নেই। বোরো মানুষের নিয়ন্ত্রণে। আমন অনেক বেশি প্রাকৃতিক, খেতেও সুস্বাদু। নামের শেষে ‘- শাইল’ থাকা মানেই আমন। যেমন নাজিরশাইল চাল। কত কিছু যে শিখছি গ্রামে এসে! একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে। অথচ আমার বাবা একজন কৃষিবিদ। তখন ভাবতাম সব আমই আম, সব চালই চাল, সব ক্ষেতই সবার ক্ষেত!

অথচ এখন বুঝি কতকিছু আরো ভাল করে দেখার ছিল! যদি পিঁপড়ে সারি মুখে ডিম নিয়ে গাছ বায়, কাক খড়খুটো টোকাতে থাকে তার বাসা শক্ত করার জন্য, পশ্চিম দিক থেকে হালকা বাতাস বয়- আকাশ যতই পরিস্কার থাকুক, মেঘ শূন্য থাকুক- কয়েক ঘন্টা বাদেই চারপাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি হবে। সারা আকাশ মেঘে ডেকে যাবে। বজ্রপাত হবে। এ গোপন শিক্ষা আমাকে নৌকার মাঝি শিখিয়েছে। আমি সেদিন টাইম ট্রাভেল করেছিলাম! বিকেল সন্ধ্যার ছবি মধ্যাহ্নেই দেখে নিয়েছিলাম- মাঝির চোখ দিয়ে!!

Platform:
Related Post