X

রক্ত পরিসঞ্চালন সম্পর্কীয় ট্যাবু এবং আমাদের ধারণা

১) রক্তশূন্যতা হলে সোজা রক্ত পরিসঞ্চালনঃ সবচেয়ে সহজ সমাধান, তাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট সমাধান।
২) “রক্ত নিন আত্মীয় স্বজন থেকে” এমন বক্তব্য অবৈজ্ঞানিক ট্যাবু এবং বিপজ্জনক।

উপরের দুটি বক্তব্যের নির্মম যৌক্তিকতার ব্যবহারিক শিকার ছবির এই হতভাগ্য ব্যক্তি।
সেদিন ১৩ই মে, আমার ইউনিটের রোগী ভর্তির দিন। মেডিসিন বিভাগ থেকে রেফার করা হয়েছে রোগীটিকে আমার পরামর্শের জন্য। রেফার করার কারন তাঁর রক্তে সবধরনের কনিকা কমে যাওয়া (pancytopenia)। ইতিহাস নিয়ে জানা গেল ৫-৬ দিন ধরে তার জ্বর, ৩-৪ দিন ধরে কাশি সহ শ্বাসকষ্ট, সেই সাথে সারা শরীরে লালচে ভাব সহ একটু ফোলা ফোলা। পূর্বের ইতিহাস নিয়ে জানা গেল লোকটি পাইলস্-এ ভুগছিলেন প্রায় দশ বছর ধরে যা থেকে প্রায়ই রক্তক্ষরণ হত। ৫-৬ মাস আগে তার জন্য অপারেশনও করান শেষ পর্যন্ত। তবে তার পরেও তিনি পুরো সুস্থ বোধ করছিলেন না। গভীর ক্লান্তি আর দূর্বলতার জন্য তিনি তাঁর কাজ কর্ম করতে পারছিলেন না বলে আবার আরেক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। তিনি রক্ত পরীক্ষা করে দেখলেন রক্তের হিমোগ্লোবিন অনেক কম, ৫ গ্রাম/ডেসিলিটারের মত। সেটা হবারই কথা দীর্ঘদিন ধরে পাইলস্-এর রক্তক্ষরণের কারনে। এবং সেটা ছিল খুব সম্ভবত আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা, যেটা কিছু পরীক্ষা করে সহজেই বোঝা যেত এবং নির্দিষ্ট পরিমানে আয়রন দিলেই হয়তো ঠিক হয়ে যেত। তবে তাঁকে ঐ সময়ে চিকিৎসা করা হয় পর পর ৩ দিন ৩ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন করে। সেটা দিন বিশেক আগের কথা। আরেকজন মানুষের শরীর থাকা আসা জৈব পদার্থ হিসেবে রক্ত একজনের শরীরে গ্রহনের সাথে যে পরিমান ও যত রকমের ঝুঁকি জড়িত তাতে আক্ষরিক আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাঁচাবার প্রয়োজন ব্যতিত রক্ত পরিসঞ্চালন পরিহার করাই বিধেয়। এই লোকটির ক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালন, তাও ৩ ব্যাগ, কতটা জীবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ছিল তা আর তখন যাচাই করার উপায় বা সম্ভাব্যতা ছিল না।
যাহোক, রক্ত নেবার পরে ১২ – ১৪ দিন একটু ভালো থাকলেও তারপর শুরু হয় বর্তমান উপসর্গসমূহ। রোগীর ইতিহাস শুনে ও চেহারা দেখে আশংকা হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম ঐ ৩ ব্যাগ রক্তের দাতাদের মধ্যে তাঁর নিজ রক্ত সম্পর্কের কেউ ছিল কি না। উত্তরে যখনই জানলাম ৩য় ব্যাগের দাতা ছিলেন তার সহোদর ভাই তখনই যেনে গেলাম হতভাগ্য লোকটির প্রায় নিশ্চিৎ মৃত্যু পরোয়ানা জারী হয়ে গিয়েছে; লোকটি রক্ত পরিসঞ্চালন জনিত বা Transfusion associated graft versus host disease (GVHD) এ আক্রান্ত, যাতে মৃত্যু সম্ভাবনা অতি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও শতকরা ৯০ ভাগের উপরে এবং সেটা কয়েক দিনের মধ্যেই। এই রোগীর ক্ষেত্রে এই প্রাণঘাতী জটিলতার কারণ মোটামুটি নিশ্চিৎভাবেই তাঁর আপন ভাই এর দেয়া রক্ত পরিসঞ্চালন। ঐ সময়ে রোগী নিজে হেঁটে আমার কক্ষে এলেও তাঁর পরিনতি সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিৎ হয়ে দ্রুত আমাদের ইউনিটে ভর্তির ব্যবস্থা করি শেষ মরিয়া চেষ্টার জন্য বা অন্তত শেষ সময়ের কিছুটা কষ্ট লাঘবের জন্য। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি নিকটাত্মীয়দেরকে। যথারীতি তার মাত্র ৩ দিন পরে মৃত্যুবরণ করেন হতভাগ্য লোকটি।

ব্যাপারটা আসলে কী ঘটেছিল তা বুঝতে গেলে জানা দরকার GVHD কী?
GVHD শব্দগুচ্ছ অত্যন্ত পরিচিত Hemopoetic Stem Cell Transplantation বা Bone Marrow Transplantation সংশ্লিষ্টদের কাছে। কারো রক্তের মধ্যে থাকা cytotoxic T-cell বা T-lymphocyte এর কাজ হোল তার কাছে অপরিচিত কোন উপাদান তার সংস্পর্শে এলেই সেটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। পরিবেশে থেকে অসংখ্য জীবানুর সংক্রমন থেকে বাঁচার জন্য প্রাণী শরীরের এটি একটি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। অন্যের শরীর থেকে রক্ত, বোন ম্যারো বা অন্য কোন অঙ্গ যেমন কিডনী, যথাযথা বৈশিষ্ট্যের মিল বা matching নিশ্চিৎ না করে আরেকজনের শরীরে নিলে এই cytotoxic T-cell সেটাকে ধ্বংস করে, যাকে বলে graft rejection. এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই ধ্বংস প্রক্রিয়ার থেকে অন্যের শরীর থেকে আসা T-cell ও বাদ যায় না। তবে রক্তের লোহিত কনিকা এবং সাধারনতঃ অনুচক্রিকা এই প্রক্রিয়ায় ধ্বংস হয় না। আর মিল বা matching বলতে যা বোঝানো হয় তা হল human leukocyte antigen (HLA) নামে পরিচিত একগুচ্ছ antigen উপাদানের মিল। তো এই antigen গুচ্ছের মধ্যে কিছু থাকে মূখ্য (major) এবং কিছু থাকে গৌন (minor)। তো এদের সম্পূর্ণ মিল বা matching প্রায় কখনো সম্ভব নয় বা সেটা প্রত্যাশিত নয় বলে, ছোট খাট অমিলের কারনে rejection ঠেকাতে কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার কারনে দাতার শরীরের কিছু T-cell গ্রহীতার T-cell কর্তৃক ধ্বংস না হয়ে বেচে যেয়ে গ্রহীতার শরীরে সংখ্যা বৃদ্ধি করে একসময় গ্রহীতার কোষ কলাকেই আক্রমন করতে থাকে। এটাকেই বলে GVHD. অর্থাৎ একই প্রক্রিয়া গ্রহিতার T-cell দাতার বিরুদ্ধে ঘটালে graft rejection আর তার উল্টো, দাতার T-cell গ্রহীতার বিরূদ্ধে ঘটালে সেটা GVHD.
এতক্ষনে একটি জিনিস বোঝা গেল যে GVHD ঘটতে গেলে গ্রহীতার T-cell এর কার্যক্রম অবদমিত থাকতে হবে যেটাকে বলে immunosupression; Bone marrow transplant করতে গেলে যেটা ওষুধ দিয়ে করা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে, সেটা অনেক রোগে এমনিতেই ঘটতে পারে যেমন এইডস, লিম্ফোমা, কিছু কেমোথেরাপী পরবর্তী অবস্থা ইত্যাদি।

আমরা হরহামেশা যে রক্তপরিসঞ্চালন করছি তাতে GVHD হচ্ছে না কেন?
কারণ গ্রহিতার শরীরের T-cell দাতার T-cell কে আগেই ধ্বংস করে দেয়। তবে যদি গ্রহিতার T- cell অবদমিত থাকে (immunosupression), যে পরিস্থিতিগুলো একটু আগেই উল্লেখ করেছি, সেরকম পরিস্থিতিতে রোগীকে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হলে সেটাকে radiation দিয়ে তার T-cell আগেই ধ্বংস করে নিতে হয়।

Immunosupression এর কারনে transplant related GVHD এর মতই transfusion associated GVHD এর ঝুঁকি থাকে সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু নিকটাত্মীয়দের থেকে রক্ত নিলে এটা কীভাবে হবে?
যদি রক্ত দাতা ও গ্রহীতা HLA এর বিন্যাস এমন হয় যে গ্রহীতার T-cell এর কাছে দাতার কোষ কলা (দাতার T-cell সহ) ‘আপন’ বা ‘self’ বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু দাতার T-cell এর কাছে গ্রহীতার কোষ কলা শত্রু বা ‘non-self’ বলে প্রতীয়মান হয়, এমন পরিস্থিতিতে দাতার T-cell গ্রহীতার শরীরে সাদরে গৃহীত হয়ে, সংখ্যা বৃদ্ধি করে পরে গ্রহীতা কোষ কলাকেই আক্রমন করে ধ্বংস করতে থাকে। সেই পরিস্থিতির জটিল ব্যাখ্যা শুধু আগ্রহীদের জন্য তুলে রেখে শুধু এটুকু বলে রাখি যে রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়ের থেকে রক্ত নিলে এমন দৃশ্যপট তৈরী হতে পারে। তবে এটা জেনে রাখা ভালো যে এমন পরিস্থিতি ইতোমধ্যে immunosupressed গ্রহীতার ক্ষেত্রে TA-GVHD এর ঝুঁকি অনেক গুন বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি দৃশ্যত immunosupressed নয় এমন রক্তগ্রহীতার শরীরেও বিরল ক্ষেত্রে GVHD ঘটাতে পারে, যেমনটি সম্ভবতঃ এই হতভাগ্য লোকটির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

TA-GVHD তে কেন মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভবী?
Transplant related GVHD এর সাথে TA-GVHD এর মূল পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এখানে রক্ত গ্রহীতার অস্থিমজ্জ্বা (bone marrow) আক্রান্ত হয়ে রক্ত কোষ উৎপাদন ব্যহত হয়। এমনকি Bone Marrow Transplant করেও পরিস্থিতি থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় না। কারন রোগীর নিজের সাথে হুবহু মিল আছে এমন কারো থেকে যদি bone marrow transplant করা হয় তবে সেটি রোগী কোষ কলার মত একই ভাবে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়। আবার যার রক্ত দিয়ে TA-GVHD হয়েছে তার থেকে বা তার সাথে মিল আছে এমন কারো থেকে নিয়ে bone marrow transplant করলে সেটা GVHD প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করবে। বোঝাই যাচ্ছে কেমন শাঁখের করাত।

‘আত্মীয় স্বজন থেকে রক্ত নিন’ এই ধরনের প্রচারনা কি তবে ভুল?
রক্তসম্পর্কীত দাতা থেকে রক্ত না নেবার পক্ষে কয়েকটি যৌক্তিক কারন রয়েছে। সেগুলো অন্য কোন সময়ে আলোচনা করা যাবে। আজ শুধু যে বিপর্যয় আমরা দেখলাম তার বিপরীতে কোন সুবিধা আদৌ আছে কি না দেখা যাক। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রথম শর্ত হচ্ছে সুস্থ ব্যক্তি কর্তৃক স্বেচ্ছায় রক্তদান। আমাদের ছাত্রজীবনে যখন স্বেচ্ছায় রক্তদান আন্দোলন শুরুর দিকে, তখন রক্তদান ছিল প্রায় সবার কাছে ভয়ের ব্যাপার, যার ফলে অধিকাংশ রক্ত আসত পেশাদার রক্ত বিক্রেতা থেকে, যারা ছিল প্রায়ই নেশাখোর ও নানা মারাত্মক রোগের আধার। এই পরিস্থিতি উত্তরনে সবাই খুজতে লাগল পরিচিত সুস্থ লোক, সেটাই কীভাবে যেন রূপান্তরিত হয়ে গেল আত্মীয়তে, কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া কিছু মনগড়া ধারণার বসে। তবে নিরাপদ রক্ত নিশ্চিৎ করা সম্ভব শুধু মাত্র সুস্থ, স্বেচ্ছা রক্তদান ও নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার মাধ্যমেই। যদি আত্মীয় হিসেবেও ভাবি তবে সমস্ত সুস্থ রক্তদাতা কারো না কারো আত্মীয় তাই সমান নিরাপদ। অতএব, নিকটাত্মীয়দের থেকে রক্ত গ্রহনের ঝুঁকির বিপরীতে লাভের পরিমান শূন্য বিধায় এমন প্রচারনা শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনকও বটে।

শেষ করার আগে ছোট্ট আরেকটি করুন গল্পের সারাংশ বলি। TA-GVHD তে আমি প্রথম মৃত্যু দেখি ২০১০ সালে, একজন নবীন চিকিৎসকের পিতার, যাঁর Hodgkin Lymphoma ধরা পড়ে ঘাড়ের lymph node biopsy করে। তো যেখানে এই biopsy করা হয় সেখানে তাঁর হিমোগ্লোবিন ৯ গ্রাম দেখে ১ ব্যাগ রক্ত দিতে বলা হয়। এবং রক্ত দেন রোগীর ছেলে ঐ নবীন চিকিৎসক। ফলা ফল, TA-GVHD এবং অবধারিত মৃত্যু, যা সহজেই এড়ানো যেত। ঐ রোগীর ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় রক্তদাতা ছাড়াও আরো যে ঝুঁকি ছিল সেটি হচ্ছে তাঁর Hodgkin lymphoma. তবে তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হল ঐ লোকটির রক্ত পরিসঞ্চালনের কোন প্রয়োজনই ছিল না, কারন তাঁর হিমোগ্লোবিন ছিল ৯ গ্রাম/ডেসিলিটার। অথচ, এমন কি আশু সংশোধনযোগ্য কারনের অনুপস্থিতিতেও, রক্ত পরিসঞ্চালন করা লাগে হিমোগ্লোবিন অন্তত ৮ গ্রামের নীচে গেলে বা ক্ষেত্র বিশেষে ৭ গ্রামের নীচে গেলে।
এরই মধ্যে আরো ২ বা ৩ টি এমন মৃত্যু দেখেছি, তাই বিষয়টাকে (TA-GVHD) একেবারে বিরল বলে হেলা করার সুযোগ নেই।

মূল শিক্ষাঃ
প্রথমতঃ জীবন রক্ষাকারী রক্তপরিসঞ্চালন হতে পারে জীবন নাশের কারন, শুধু TA-GVHD থেকে নয়, আরো বিভিন্নভাবে। তাই রক্ত পরিসঞ্চালন হোক শুধু প্রান রক্ষার প্রয়োজনে, মামুলি হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য নয়।
দ্বিতীয়তঃ আত্মীয় স্বজন থেকে রক্ত নেবার অবৈজ্ঞানিক, তদুপরি বিপজ্জনক ট্যাবু দুর হোক এখনই।

সোনালী সাহা:
Related Post