X

বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের করোনা “ভ্যারিয়্যান্ট” এক নয়

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০, শুক্রবার

লেখাঃ ডা. মো. মারুফুর রহমান
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মেডিকেল বায়োটেকনোলজি)
এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ভুল তথ্য/মিথ্যা খবরঃ বাংলাদেশে করোনার নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেছে/ যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইনের সাথে মিল পাওয়া গেছে/ যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন পাওয়া গেছে।

প্রকৃত তথ্যঃ করোনাভাইরাসের এখন পর্যন্ত স্ট্রেইন/প্রকরণ একটাই। তবে এর অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট/ধরন আছে যা প্রতিবার বিভিন্ন মিউটেশনের মাধ্যমে তৈরি হয়। চলমান মহামারীর করোনাভাইরাসে প্রায় প্রতিমাসে দুটি করে মিউটেশন ঘটে যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যতবার আলাদা মিউটেশন ঘটে ততবারই আলাদা ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয় সে হিসেবে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের এখন বহু ভ্যারিয়েন্ট আছে। যুক্তরাজ্যে যে ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে সেটিতে ১৭টি সুনির্দিষ্ট মিউটেশন আছে। এই ১৭টির মাঝে মাত্র একটি মিউটেশনের সাথে আংশিক মিল পাওয়া গেছে বাংলাদেশের আরও ২ মাস আগের ৫টি নমুনায়। এই তথ্য দিয়ে কোনভাবেই বলা যায় না যে, বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের ধরনটি পাওয়া গেছে বা মিল আছে। আমি যদি বলি আমার চাচাতো ভাই এর চোখের মণির রঙ গাঢ় বাদামী আর আমারটা হালকা বাদামী তাই আমরা আসলে একই লোক, এটি যেমন ভুল কথা হবে তেমনি উপরের খবরটিও ভুল। একটি ভাইরাসের একটি ভ্যারিয়েন্ট আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট এর সাথে কতটা সম্পর্কিত সেটি জানার জন্য বিজ্ঞানীরা ফাইলোজেনিক ট্রি বানান যেটি অনেকটা বংশ ধারার ছকের মত। সারাবিশ্ব থেকে প্রতিনিয়ত জমা হওয়া করোনাভাইরাসের জিনোম নিয়ে এই বংশধারা নিয়মিতভাবে বানানো হচ্ছে Nextstrain নামের ওয়েবসাইটে। সেই ওয়েবসাইট থেকেই বাংলাদেশের ২ মাস আগের ধরনটি এবং যুক্তরাজ্যের আলোচ্য ধরনটির মাঝে মিল কতটুকু সেটির ছবি নিয়েছি (ছবি-১)।

দেখা যাচ্ছে বংশগতির সম্পর্কের বিচারে বাংলাদেশের ধরনটি (যেটির সাথে যুক্তরাজ্যের মিল আছে বলে কথা হচ্ছে) তার সাথে যুক্তরাজ্যের আলোচ্য ধরনটির সম্পর্ক বহু বহু বহু দূরের। অনেকটা সে আমার পরদাদার পরদাদার পরদাদার পরদাদার পরদাদার চাচাতো ভাইয়ের ফুফাতো বোনের নানীর বড় ছেলের মেঝ শালার আপন মামার দূর সম্পর্কের চাচার………তো ভাই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন মিলটা কোথায়! আমাদের সেই আলোচ্য ধরনটির সাথে বরং নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু নমুনার মিল আছে (ছবি-২)।

ভুল/মিথ্যা খবরঃ বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা/বিসিএসআইআর ২ মাস আগেই করোনার নতুন ধরনের/স্ট্রেইনের সন্ধান পেয়ে জানায়নি বা চুপ করে ছিলো।

প্রকৃত সত্যঃ আগেই বলেছি নতুন নতুন মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন ধরন তৈরি হওয়া ভাইরাসের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং এমন প্রত্যেকটা নতুন ধরনের সংক্রমণ ও রোগ তীব্রতা তৈরির প্রবণতা ভিন্ন না। এর মাঝে কোনো কোনোটির হয়তো ভিন্ন হতে পারে। ফলে প্রত্যেকবার জিনোম সিকোয়েন্স করে প্রত্যেকটি মিউটেশনের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা (তাও সব সময় জানা সম্ভব না) দেবার কোন মানে নেই, সেটি তামাম দুনিয়ার বিজ্ঞানীরদের গবেষণার জন্য এমনিতেই উন্মুক্ত ডাটাবেইজে জমা দেয়া হয়। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি নিয়ে হয়তো সংবাদ সম্মেলন করা যায় যেটি বিসিএসআইআর প্রায়শই করে। তাই, ২ মাস আগে যখন তারা ৫টি নমুনাতে P681R মিউটেশনটি পায় সেটি ঘটা করে জানায়নি তবে সারাবাংলা অনলাইন পোর্টালে খবরটি এসেছিল। যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনটির ১৭টি মিউটেশনের একটি এই একই জায়গায় ঘটেছে সেটি হলো P681H। এখন এই জায়গাটি স্পাইক প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই করোনার বংশবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা বলেননি যে এই একটি মিউটেশনের কারণেই তাদের ধরনটির সংক্রমণ প্রবণতা বেশি বরং তারা ১৭টির সম্মিলিত ফলাফল নিয়েই চিন্তা করেছেন এবং এর মাঝে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন N501Y নামের মিউটেশনটির ব্যাপারে যেটি বাংলাদেশের নমুনায় নেই। বাংলাদেশের নমুনার মিউটেশনটির সাথে সংক্রমণ কম বেশি হবার সম্পর্ক আছে কিনা সেটি বিসিএসআইআর এর কাছে যে তথ্য আছে তা দিয়ে বোঝা সম্ভব না। তবে কম্পিউটেশনাল এনালাইসিস করে হয়তো কিছুটা ধারনা বের করা সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে তিন শতাধিক জিনোম এর উপরে এ ধরনের একটি কম্পিউটেশনাল এনালাইসিস আমরা করেছি গত সেপ্টেম্বরে যেটি এই লিংকে পাওয়া যাবেঃ
shorturl.at/fsLX1
সুতরাং বিসিএসআইআর নতুন স্ট্রেইন পেয়েছে এবং কাউকে জানায়নি এটি আসলে ভুল কথা। বিসিএসআইএর বরং ধন্যবাদ প্রাপ্য যে তারা অযথা প্যানিক তৈরি করেনি। আরও একটি কারণে তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য, সেটি হলো-

আন্তর্জাতিক ডাটাবেইজের তথ্য অনুসারে যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত ১৩৫৫৭২টি করোনাভাইরাস নমুনার জিনোম সিকয়েন্সিং করেছে যার মাঝে নতুন ধরনটিরই ৩৫৪৭টি নমুনা। তারা এই সিকয়েন্সিং ডাটার সাথে পেশেন্ট ডাটা মিলিয়ে দেখেছে নভেম্বর থেকে এই ধরনটি বাড়ছে এবং এটির সংক্রমণ প্রবণতা ৭০ শতাংশ বেশি। আমাদের দেশ থেকে এ পর্যন্ত ৪৮৯ টি করোনাভাইরাস নমুনার পূর্নাঙ্গ জিনোম সিকয়েন্সিং করা হয়েছে যার মাঝে বিসিএসআইআরই করেছে ২৮০টির, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি। বিসিএসআইআর ছাড়াও আরও ১০টির বেশি ল্যাব সিকয়েন্সিং করেছে এর মাঝে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআর, ডিএনএ সল্যুশন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বিআইটিআইডি, এনআইবি অন্যতম। সুতরাং কাজের অনুপাত বিচারে সর্বোচ্চ অবদান বিসিএসআইআর এর। এতদিন এর গুরুত্ব কেউ বোঝেনি, তাদের ধন্যবাদ দেয়নি এখন সিকয়েন্সিং এর গুরুত্ব প্রকাশিত হওয়ায় আমরা উল্টো তাদের পেছনে লেগেছি ভুলভাল নিউজ করে।

হতাশা আর আশংকার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের সিকয়েন্সিং নমুনায় যুক্তরাজ্যের অধিক সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যায়নি তার মানে এই না যে সেটি বাংলাদেশে নেই বা আসবে না। এমনকি যুক্তরাজ্য থেকে না এসে সেটি অন্য জায়গা থেকেও আসতে পারে বা স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত ইউরোপের মত আমাদের দেশে দ্বিতীয় ঢেউ এর তীব্রতা অনেক বেশি নয় যা থেকে আমরা বলতে পারি যে আমাদের দেশে অধিক সংক্রামক কোনো ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে। আবার আমাদের মাঝে টেস্ট করার প্রতি উদাসীনতাও তৈরি হয়েছে, করোনার সাধারণ লক্ষণ (জ্বর, কাশি, গলাব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, নাকে গন্ধ না পাওয়া) প্রকাশ পেলেও বা আক্রান্ত মানুষের কাছে গেলেও অনেকে টেস্ট করাচ্ছেন না। নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে কিনা সেটি জানার জন্য যে পরিমাণ সিকয়েন্সিং দরকার তা বাংলাদেশে হচ্ছেনা। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানে আমরা ৩ মাস ধরে বসে আছি, কিটের অভাবে সিকয়েন্সিং করতে না পেরে। এইসব গবেষণা খাতে বরাদ্দ অনেক অনেক কম, জটিলতা অনেক অনেক বেশি এবং সত্যিকার অর্থে এই ধরনের গবেষণায় বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে প্রশিক্ষিত জনবল নেই এমনকি এ সংক্রান্ত ডিগ্রীও প্রচলিত নেই বা থাকলেও তা বিএমডিসি অনুমোদিত নয়। ২০১০ সালের গেজেটের আলোকে সেন্টার অফ এক্সিলেন্স হিসেবে জাতীয় মেডিকেল বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট তৈরি হবার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ডিপিপিই তৈরি হয়নি নানা জটিলতায়। যাহোক, এসব সমস্যার আশা করি দ্রুত সমাধান হবে। মেডিকেল বায়োটেকনোলজি সেক্টর বাংলাদেশে বিকশিত হবে এবং তা সকলের গবেষণার জন্য উন্মুক্ত হবে এই আশা নিয়ে এখনো টিকে আছি।

সুতরাং, আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। তবে সচেতন হোন, লক্ষণ থাকলে বা লক্ষণযুক্ত কারও সংস্পর্শে এসে থাকলে পরীক্ষা করান, আগে আগে চিকিৎসা শুরু করলে জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তারও আগে মাস্ক পরুন ও জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। কারণ মিউটেশনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যদি কমেও যায় মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কার্যকারিতা কমবে না। সুতরাং আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র মাস্ক।

হৃদিতা রোশনী:
Related Post