X

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স থেকে যা আমরা জানলাম

১৫ মে, ২০২০, শুক্রবার

কঠিন আলোচনায় যাবার আগে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সমীর সাহা স্যার ও সেঁজুতি সাহা আপুর প্রতি অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তাঁরা ভাইরাসটির জিনোম সিকয়েন্সিং এর কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বলে। বাবা-মেয়ে এই জুটির এ ধরনের গুরুত্বপুর্ণ কাজ এই প্রথম না, বরং স্বাস্থ্য খাতে গবেষণায় তারা দীর্ঘদিন ধরেই অবদান রেখে আসছিলেন। তাদের কাজের জন্য তারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিল গেটস, জাকারবার্গের মত বিশ্বব্যক্তিত্বরা তাদের কাজের প্রশংসা করে অভিনন্দন জানিয়েছে বহুবার।

এদেশে চিকুনগুনিয়া আউটব্রেকের সময় চিকুনগুনিয়া বাচ্চাদের মেনিনজাইটিস করতে পারে, এই গুরুত্বপূর্ন তথ্যটিও তাদের বের করা। আশা করছি কোভিড প্যান্ডেমিককে বসে আনতে আপনাদের চলমান কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকবে।

চলে আসি মূল আলোচনায়। আমার আগের স্ট্যাটেসে বলেছিলাম করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা থেকে আমরা কি জানতে পারি। জানার জন্য আসলে দরকার বায়োইনফরমেটিক এনালাইসিস। তাই প্রথমে বাংলাদেশের জমা দেয়া সিকয়েন্সটি বের করলাম এবং Nextstrain সহ বেশ কিছু অনলাইন ও অফলাইন বায়োইনফরমেটিক টুল এর সহায়তা নিয়ে জানার চেষ্টা করলাম আমাদের এই ভ্যারিয়েন্টটির গল্পটা কেমন।

নেক্সটস্ট্রেইনে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে জমা দেয়া সিকোয়েন্সগুলোর সাথে আমাদের এই সিকোয়েন্স তুলনা করে (ফাইলোজেনিক ট্রি) দেখা যায় আমাদের সিকোয়েন্সটির আত্নীয়তা মূলত ইউরোপিয়ান কিছু দেশের সাথে। তবে আশেপাশে কুয়েত, ভিয়েতনাম ও অস্ট্রেলিয়ায়ও আছে। এই ফাইলোজেনিক ট্রি এর সাথে সিকোয়েন্সগুলোর সময় হিসাব করে দেখা যায়, সম্ভবত বেলজিয়াম বা তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে ভাইরাসটির এদেশে এসে থাকতে পারে (অন্তত যে রোগীর স্যাম্পল নিয়ে আমরা পরীক্ষাটি করেছি তার ক্ষেত্রে হয়তো ঘটনাটি এমন)।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই এনাইলাইসিসটি GISAID ডাটাবেইজের উপর ভিত্তি করে NEXTSTRAIN ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। অন্য কোন ডাটাবেস নিয়ে এনালাইসিস করলে রেজাল্ট ভিন্ন হতে পারে। এছাড়া একজন রোগীর স্যাম্পল দিয়ে আসলে ভাইরাসটি বাংলাদেশে কোন পথে ঢুকেছে সেটি বলা যায়না। এজন্য আর অনেক বেশি স্যাম্পল থেকে আরও সিকোয়েন্স লাগবে। সমীর স্যার ও সেঁজুতি আপারা আরও করছেন, এছাড়া আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করার চেষ্টা করছে। আমরা শীঘ্রই হয়তো আরও ভালো কিছু এনালাইসিস পাবো।

এবার আমাদের হাতে থাকা সিকোয়েন্সটি থেকে আর কি জানা যাচ্ছে সেটা দেখি। আমরা রেফারেন্স সিকোয়েন্স (উহানের যে সিকোয়েন্সটির সাথে সব তুলনা করে দেখা হয়) এর সাথে তুলনায় দেখতে পাই উহানের ভাইরাস এর সাথে আমাদের এই ভাইরাসটির জেনেটিক কোডে ৯ যায়গায় অমিল আছে (মিউটেশন)। এখন এই অমিল মানেই যে চেহারা বদলে যাবে (প্রোটিন পরিবর্তন হবে) তা নয়। আবার চেহারা বদলালেই যে কাজের ধরন (ইনফেকশনের ধরন) পরিবর্তন হবে তাও নয়।

করোনাভাইরাস এর সবগুলো প্রোটিনের কোনটার কি কাজ তাও আমরা ঠিকঠাকভাবে জানি না। তবে যেটুকু জানি, তার মাঝে সবচেয়ে বেশি জানাটা হলো স্পাইক প্রোটিন সম্পর্কে। যেটি দিয়ে ভাইরাসটি আমাদের শরীরের কোষে ঢোকে। দেখা গেছে উহানের ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন আর আমাদের ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের মাঝে একটা মিউটেশন আছে। প্রোটিনটার ৬১৪ নাম্বার পজিশনে এমাইনো এসিড এসপারটেট এর জায়গায় গ্লাইসিন বসে গেছে (D614G)। এতে করে স্পাইক প্রোটিনের চিহ্নিত অংশে (নীল রঙ) পরিবর্তন হয়। এই ছবিটি স্পাইক প্রোটিন আমাদের শরীরের কোষের ACE2 নামের দরজার সাথে লেগে থাকা অবস্থার। দেখা যাচ্ছে মিউটেশনটির কারনে স্পাইক প্রোটিনের যে যায়গার মাধ্যমে ACE2 এর সাথে যুক্ত হয় সে যায়গাটিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আশা করা যায় এই কারনে হয়তো বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হবেনা তবে পরিবর্তনটা ভেতরে থাকলেও অনেক সময় প্রোটিন এর কাজ আরও ভালো বা খারাপ হয়ে যেতে পারে।

স্পাইক প্রোটিনে এই মিউটেশনটি কিন্তু আমাদের দেশেই প্রথম এমন না। এটা বিশের ৭২টি দেশের সিকোয়েন্সে দেখা গেছে যা মোট সিকোয়েন্সের প্রায় ৬৫%।

এই সুনির্দিষ্ট মিউটেশনটির কারনে কি হয় এটা নিয়ে কেউ কাজ করেছে কিনা খুঁজতে যেয়ে দেখলাম, আমার আলমা ম্যাটার যুক্তরাজ্যের দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ডের মেডিকেল স্কুলের আমার শিক্ষকেরাই কিছু কাজ করেছেন। তাদের পেপারটি থেকে ([biorxiv.org](biorxiv.org/content)

জানলাম এই মিউটেশনটি ফেব্রুয়ারির দিকে ইউরোপে শুরু হয় এবং এটাই দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে এখন এরাই ইউরোপের করোনাভাইরাস এর মূল টাইপ। জানা যায় পুরো ইউরোপ জুড়ে তাণ্ডব করা করোনাভাইরাস এর মূল টাইপটিতে স্পাইক প্রোটিনে D614G, nsp3 জিনে C>T এবং RdRp প্রোটিনে P323L মিউটেশন রয়েছে।

আমাদের সিকোয়েন্সটিতে খুঁজে ঠিক এই যায়গায়গুলোতে একই মিউটেশন পেলাম, যা এটার ইউরোপ থেকে আসার পক্ষেই প্রমাণ দেয়। ইউরোপে ইতালি আর সুইজারল্যান্ড বাদে সব অন্য যায়গায় স্পাইক প্রোটিনের ৬১৪ নাম্বার পজিশনে D থাকা ভাইরাসের টাইপটিই মূল ছিলো, কিন্তু মার্চ থেকে G মিউটেশন ওয়ালা ভাইরাসটি বাড়তে শুরু করে এবং খুব দ্রুত পুরো ইউরোপে এইটাই মূল ভ্যারিয়েন্ট হয়। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও G টাইপটি ঢোকে এবং ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক সহ প্রায় সব শহরে এই টাইপটিই বেশি ছড়াতে থাকে। এসব থেকে অনুমান করা যায়, সম্ভবত G মিউটেশনের ভাইরাসটির ছড়ানোর সক্ষমতা বেশি।

ছড়ানোর সক্ষমতা কেন বেশি সেটি খুঁজতে গিয়ে দুটো থিওরি পাওয়া গেলো। D থেকে G হবার কারনে স্পাইক প্রোটিনের দুটো অংশের মাঝে রাসায়নিক বন্ধন কাটা সহজ হয় (কোষে ঢোকার জন্য দরকার)। এছাড়াও জানা গেলো ৬১৪ নাম্বার পজিশনটি এমন যায়গায় অবস্থিত, যেখানের সাথে নানা রকম জৈব রাসায়নিক ইন্টারএকশনে আমাদের শরীররে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় (memory B-Cell induction) এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে। এখানে D থাকলে শক্ত প্রতিরোধ তৈরি হয়, G থাকলে সম্ভবত সেটা হয়না। এরপরে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ডের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৫৩ জনের উপরে পরীক্ষা করে দেখা গেলো মার্চ থেকে বেশি মানুষ G মিউটেশনে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তবে D টাইপ এবং G টাইপ ভাইরাস এর মাঝে ক্লিনিক্যাল কোন পার্থক্য (রোগের জটিলতা) পাওয়া যায়নি। একটা জিনিস পাওয়া গেছে সেটা হলো G টাইপের ইনফেকশনে শরীরে ভাইরাস এর পরিমাণ বেশি থাকে (ভাইরাল লোড)।

লেখা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, আরও এনালাইসি ও অন্য মিউটেশনগুলো নিয়ে আলোচনা পরের পর্বে থাকবে। একটিমাত্র সিকোয়েন্স দিয়ে পুরো বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করা কঠিন, তাই আমাদের আরও সিকোয়েন্স করতে হবে এবং সেগুলো প্রকাশের অপেক্ষায় থাকতে হবে। যদি দেখা যায় স্পাইক প্রোটিনে D614G মিউটেশনটাই বেশি পাওয়া যাচ্ছে তাহলে আমাদের আরও বেশি সাবধান হতে হবে কেননা এই টাইপটিই ইউরোপ ও আমেরিকায় সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষকে ইনফেক্টেড করেছে, সম্ভবত এর ছড়ানোর সক্ষমতা বেশি হবার কারনে।

(এনালাইসিসে ব্যবহৃত বায়োইনফরমেটিক্স টুল/পোর্টালঃ Nextstrain, EpiCoV, NCBI Blastn, UCSC Genome Browser, Genome Detective, RCSB Protein DataBank, MEGAX)

ডা. মারুফুর রহমান অপু
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মেডিকেল বায়োটেকনোলজি), এমআইএস স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

Platform:
Related Post