X

চমেকহা’র নির্দেশনা মানছে কি স্বাস্থ্যনীতি?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩১ মে ২০২০, রবিবার

গত ৩০ মে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল চিকিৎসক বা কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মেনে চলার জন্য অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শামীম হাসান একটি জরুরি নির্দেশনা প্রদান করেন।

নির্দেশনাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এতে ৫ টি সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।

১) যে সমস্ত শিক্ষক/ চিকিৎসক/ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোভিড-১৯ পজিটিভ হবেন কেবল মাত্র তারা ১০ দিনের আইসোলেশন বা হাসপাতালে অবস্থান করার সুযোগ পাবেন।

২) যে সমস্ত শিক্ষক/ চিকিৎসক/ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসবেন তাদের কাউকে কোনো প্রকার আইসোলেশনে যেতে হবে না। কেউ গিয়ে থাকলে তিনি অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য হবেন।

৩) যে সমস্ত শিক্ষক/ চিকিৎসক/ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোভিড-১৯ পজিটিভ কোন ব্যাক্তির সাথে কোন ফ্ল্যাট বা বাসায় অবস্থান করেন এবং ঐ ফ্ল্যাট বা বাসা লকডাউন হলেও ঐ সমস্ত শিক্ষক/ চিকিৎসক/ কর্মকর্তা-কর্মচারী কে লকডাউনের আওতার বাইরে ধরে নিয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত হতে হবে।

৪) সকল শিক্ষক/ চিকিৎসক/ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিস সময় সূচী অনুযায়ী সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২.৩০ টা পর্যন্ত কর্মস্থলে উপস্থিত নিশ্চিত করতে হবে।

৫) কোনো সুরক্ষা সামগ্রী অত্র কার্যালয় থেকে সরবরাহের সুযোগ নেই।

এই নোটিশটি ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সাম্প্রতিককালে জাতীয় কোভিড-১৯ ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনটির সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা থেকে এরই মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীদের হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবার শর্তও পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে নতুন গবেষণার প্রেক্ষিতে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে এই নতুন বিতর্কিত নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই নোটিশটি কার্যকর হবে সকল চিকিৎসক, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত বন্ধ আছে। এখনো স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোন নির্দেশনা দেয় নি দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ। অথচ এই অবস্থায় কর্মতৎপরতা দেখিয়ে কার নজর কাড়তে সকল শিক্ষক কর্মচারীদের অযথা অফিস করিয়ে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। সারাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিসরে খুলে দেবার সময় দেশব্যাপী কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার রোধকল্পে সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেই বিধিমালাও মানছে না খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্হ এই প্রতিষ্ঠান।

সর্বশেষ সংশোধিত নির্দেশনাটিতে ১২ দফা নির্দেশ দেওয়া হলেও মানা হচ্ছে এসব নির্দেশ। এতে বলা হয়েছিল সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মেপে তারপর অফিসে আসতে দেবার জন্য। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নেই এধরনের কোন উদ্যোগ। কোন কর্মচারীকে অসুস্থ পাওয়া গেলে তাকে কোয়ারেন্টাইন করার নির্দেশনা থাকলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ তার নির্দেশনায় বলছে, জ্বর হলে, কাশি থাকলে, শ্বাসকষ্ট বা কোভিডের উপসর্গ নয় বরং টেস্ট করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত বলে প্রমাণিত হলেই কেবল পাওয়া যাবে আইসোলেশনের অনুমতি।

সাম্প্রতিক গবেষণা ও জাতীয় গাইডলাইন বলছে উপসর্গবিহীন কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ১০ দিন পর্যন্ত আইসোলেশনের প্রয়োজন রয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে তা ২১ দিন, এমনকি ক্রিটিক্যাল রোগীর ক্ষেত্রে তা আরো বেশি হতে পারে। এসব সম্ভাবনাকে একরকম উড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কতৃপক্ষ বলছেন সকল কর্মকর্তা কর্মচারী পজেটিভ হলে ১০ দিনের আইসোলেশনে থাকবেন। স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য ইতিপূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল ‘উপসর্গবিহীন রোগী ১০ দিন পরে কাজে যোগ দিতে পারবেন’ সেই নির্দেশনা চট্টগ্রামে এসে হয়ে গেছে বাধ্যতামূলকভাবে ‘১০ দিন পরে যোগদান করবেন’। সাধারণত যে কোন রোগে সুস্থ হবার পরে তার কাজে যোগদানের বিষয়টি কেস বাই কেস ভিত্তিতে সিধান্ত নেন চিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসক। এখানে একদিকে যেমন সেই অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে, দেওয়া হয় নি রোগীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট হবার সুযোগ অন্যদিকে ধরেই নেওয়া হয়েছে, সকল চিকিৎসক উপসর্গবিহীনভাবেই আক্রান্ত হবেন, কারো হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে না, কেউ ক্রিটিক্যাল হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদককে জানান,

‘সরকার তার কর্মীর স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন বলেই বিএসআর, পার্ট ১ বিধি ১৯৬ মতে সংগনিরোধ ছুটির সুযোগ রেখেছেন। এতে সাধারণত ২১ দিন থেকে ৩০ দিন ছুটি দেওয়া হয়। তবে কলেরা, গুটি বসন্তের মত রোগ তালিকায় থাকলে কোভিড-১৯ মহামারীর মত ভয়ংকর রোগটি এই সংগনিরোধ ছুটির কারণের তালিকায় নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই তালিকা সর্বশেষ সংশোধন করেছিল ১৯৭৫ সালে।’

ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে চিকিৎসকগণ তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য হাসপাতালে আসতে গিয়ে নানা ধরনের হেনস্তার স্বীকার হচ্ছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেলের নতুন নোটিশে বলা হয়েছে কোন কারণে তার বাসা লকডাউন হলেও তাকে কর্মস্থলে আসতে হবে। সাধারণত সরকারের উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন এই ‘লক ডাউন’ করে থাকে। বলা হয়েছে একই ফ্লাটে বা বাড়িতে আক্রান্ত কেউ থাকলেও তাকে হাসপাতালে আসতে হবে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিকিৎসক বা কর্মচারী জনগন কতৃক হেনস্থার স্বীকার হলে তার দায়ভার কে নেবে? প্রশাসন কেনই বা চিকিৎসককে ইমিউনিটি দেবে? চট্টগ্রাম মেডিকেলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ বা স্থানীয় সরকারের সাথে কোন আলোচনা না করেই এককভাবে এই সিধান্ত নেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসিক সাবজেক্টের একজন শিক্ষক বলেন,

‘যেখানে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা দিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নানা উদ্দোগ নিচ্ছেন সেখানে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলেও জানানো হচ্ছে নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবারহের কোন ব্যবস্থা নেই। বলা হচ্ছে সে সব হাসপাতালে পাওয়া যাবে। আমরা তো হাসপাতালের অধীনস্হ নয়, তারা আমাদের কেন দেবেন? আমরা কী তবে অভিভাবকহীন?’

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাব থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় নতুন করে প্রায় ৯ জন চিকিৎসক ৩০ মে তারিখে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসকদের মাধ্যমে রোগীর যথাযথ সেবা প্রাপ্তির জন্য চিকিৎসকের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা খুবই জরুরী। চিকিৎসা নিতে এসে রোগী বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালন করতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী চিকিৎসকের মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হোক এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। সরকারি স্বাস্থ্য নির্দেশনার পূর্ণ প্রতিপালনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মুক্ত কর্মস্থলের সরকারের যে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা উচিৎ।

Platform:
Related Post