X

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে একদিন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ
১৩ মে, ২০২০, বুধবার

লেখা:প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ

অদৃশ্য বা অজানায় মানুষের যেমন ভয় ডর আতংক কাজ করে, তদ্রুপ চিন্তার ক্ষেত্রেও অনেক নাম না জানা অদ্ভুত অলীক চিন্তার ডালপালা গজায়; দৃশ্যমান বস্তুতে যা সম্ভব না৷

সেনাবাহিনীর চাকুরিতে যারা চিকিৎসক হিসেবে এএমসিতে যোগদান করেন, ব্যাসিক ট্রেইনিং এর পরই তাদের সেনাবাহিনী থেকে পার্বত্য অঞ্চলে পোস্টিং হয়। বিমান, নৌ ও বিজিবি (প্রাক্তন বিডিআর) তে ডেপুটেশনে যায়৷ বিজিবি থেকেও পার্বত্য অঞ্চলে যাবার সম্ভবনা থাকে৷
যেহেতু পার্বত্য অঞ্চল দুর্গম, ম্যালেরিয়া প্রবণ ও শান্তিবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে অতি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কিছু কিছু অফিসার তদবির করে পার্বত্য অঞ্চলে যেত না৷ তাদের আচরণে মনে হতো হিল ট্র‍্যাক্টস মানেই ম্যালেরিয়া, ব্ল্যাক ওয়াটার ফিভার, কোমা- ডেথ৷
সে ভয় আমাকেও পেয়ে বসেছিল। রাঙামাটির মাইনীমুখ যাকে বাংলাদেশের কাশ্মীর বলে জানে মানুষ, সেখানে পোস্টিং হবার পর শুভলং ক্রস করার সময় স্পিডবোটে বসে এসএমজি হাতে দুই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শান্তিবাহিনী খুঁজেছি আর “আয়াতুল কুরসি” পড়েছি৷ জানতামই না ওই পাহাড়ে আমাদের সৈনিকরা রুট প্রোটেকশনে আছে৷ সেদিন আমি জার্নিটা শান্তি বাহিনী আতঙ্কে উপভোগ করতে না পারলেও দু’বছর দশ মাসের দীর্ঘ সময় আর কখনো এমন মনলোভা দৃশ্য উপভোগে কার্পণ্য করিনি।

করোনা ক্রাইসিস একটা বাস্তবতা, কিন্তু এই অদৃশ্য অতিসূক্ষ্ম জীবাণুতে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করছে, কাজ করছে আতংক৷ এমনকি চিকিৎসকরাও যথাযথভাবে পরিস্থিতিকে বিবেচনা করতে পারছে না, মোকাবেলায়ও তদ্রুপ সমস্যা রয়ে যাচ্ছে৷

যেসব অফিসারগণ পার্বত্য অঞ্চলে চাকরি করেনি, তারা অন্যদের সেসব গল্প বা স্মৃতিচারণের সময় চুপসে যেত৷ তদ্রুপ উপজেলায় চাকরি না করা চিকিৎসকগণ নিশ্চিত তাদের জীবনের বড় একটা অধ্যায়কে মিস করলেন। সবকিছুতেই সাধারণের মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠার সামাজিক ও কৃষ্টিগত একটা গুরুত্ব আছে৷

করোনা হাসপাতালগুলোতে ভূতুড়ে পরিবেশ বিদ্যমান। অভিযোগের শেষ নেই অথচ চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সারাদিন খাটছে, নিজেদের জীবন শেষ করে দিচ্ছে৷
রোগী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলা দরকার, তাদের কথা শোনা প্রয়োজন। তাদের মনোবল অটুট ও প্রফুল্ল রাখা খুব জরুরি।

সেই অনুভূতি নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালের পরিচালকের সাথে কথা বলে আজ গেলাম তার অফিসে৷ খুব ধৈর্যশীল অমায়িক এই পরিচালক আমাকে কিভাবে কাজ করব জানতে চাইলে আমি জানালাম। প্রোপার প্রটেকশন নিয়ে ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী ও তাদের কেয়ারগিভারদের সাথে আলাপের, কাউন্সেলিংয়ের অনুমতি দিয়ে আমাকে নিয়ে কনফারেন্স হলে গেলেন৷
ঊনচল্লিশতম বিসিএস এর নতুন চিকিৎসকরা জয়েন করতে এসেছে৷ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল তাদের উদ্যেশ্যে প্রারম্ভিক কথা শেষ করে আমাকে কথা বলতে আহ্বান করলেন৷ তিনি একজন অভিভাবকের মত নতুন চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে কিছু অতি জরুরি কথা বললেন৷ খুব স্পষ্টভাবে থেমে থেমে তিনি তাদের সাহস রেখে মন দিয়ে কাজ করার আহ্বান জানালেন৷ আশ্বস্ত করলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা মেনে চললে কেউ আক্রান্ত হবে না৷ ওদের দেখে আমার খুব ভালো লাগল৷ অধিকাংশই মেয়ে চিকিৎসক, বাইরে অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন বাবা, ভাই, স্বামী৷ জামিল যেখানে নবাগতদের আপনি সম্বোধন করছিল, আমি আমার ছেলে মেয়েগুলোকে সরাসারি তুমি বলে সম্বোধন করে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বললাম৷
মানুষের সেবা প্রদানের সর্বোচ্চ সুযোগ তাদের আজ এসেছে, যার আকাঙ্ক্ষা তারা এতদিন করে এসেছিল৷ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা রচনায় জীবনের লক্ষ্য চিকিৎসক হওয়ার পক্ষে হাজারো চমৎকার যুক্তি দিয়ে আসার বাস্তব প্রমাণ রাখার ক্ষণ আজ৷ কুরআন পড়ার, নামাজ আদায়ের, রোজা রাখার, জাকাত আদায়ের মাধ্যমে যে আল্লাহকে খুশি করতে চায়, তার জন্য এই হাসপাতালের প্রতি বেডে বেডে আল্লাহর রহমত অপেক্ষমান৷

তাদের উদাহরণ দিয়ে বললাম-
“শীতের স্থির নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মেলে না, ইলিশ মেলে শ্রাবন প্লাবিত নদী বা উত্তাল সাগরে যেখানে ট্রলার ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরে জেলে৷ বিজয়ের জন্য জীবনে ঝুঁকি নিতে জানতে হবে, শিখতে হবে।”
একাত্তরের যুদ্ধের উপমা দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করে বললাম, “সেদিন দৃশ্যমান শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছে, সব মানুষ আক্রান্ত হয়নি৷ শুধু বাংলাদেশে যুদ্ধ ছিল, ভারতসহ অনেকেই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে৷ কিন্তু আজ?
সারা বিশ্ব আক্রান্ত! কে কাকে সাহায্য করবে? আর শত্রু অদৃশ্য, অদ্ভুতভাবে বিরাজিত৷ অতএব এই যুদ্ধ আরো ভয়াবহ, ভয়ংকর হবে পরিণতি যদি হুঁশে না থাকি৷ পর্যাপ্ত প্রোটেকশন নিয়ে কাজ করতে হবে, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা৷ আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহর হুকুম ছাড়া মৃত্যু হয় না- অতএব ভয় পাব না৷ নিজের দায়িত্ব পালন করব- এতে মনোবল বাড়ে, আত্মা শান্তি পায়৷”
ওদের স্বাগতম জানিয়ে প্রাণভরে দোয়া করে বক্তব্য শেষ করলাম৷

পরিচালকের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে প্রথমে পিপিই নিলাম৷ উপরি সাদা এই পিপিই, ফেস শিল্ড, গগলস, সুকভার পরে পুরুষ করোনা ওয়ার্ডে ঢুকে এক একজন রোগীর কাছে গেলাম, তাদের কেয়ারগিভারদের সাথে কথা বললাম৷
একটা সাধারণ ওয়ার্ডের মতই মনে হল এই ওয়ার্ড৷ রোগীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যদিও দূরে দূরে৷
রোগীরা অধিকাংশই তরুণ৷ বয়স্ক এক দম্পতির স্বামীর এখনো পজিটিভ থাকলেও স্ত্রী নেগেটিভ হয়ে স্বামীকে আশ্বস্ত করছে৷ তার প্রশান্ত চাহনি৷
কেউ কেউ আইসিইউ থেকে ফিরেছে৷
তিন হাসপাতালে ধাক্কা খেয়ে, দুই লাশের মাঝের সীটে অবস্থান করে কুর্মিটোলা এসে একজন বেশ খুশি। এই যুবক ভদ্রলোকের মাস্ক সরানোর পর অক্সিজেন নেয়া অবস্থায় মুখে হাসি দেখেছি৷

আরেক ভদ্র মহিলার মানসিক বল দেখে আমি অবাক৷ কেরানীগঞ্জ থেকে মহানগর হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে টেস্ট পজিটিভ রিপোর্ট নিয়ে কুর্মিটোলা আসে৷ বলে – “স্যার চার বাচ্চাকে ভগবানের উপর ফেলে রেখে আমি আমার স্বামীকে নিয়ে পাগলের মতো ছুটছি, তার শ্বাস কষ্ট” – মনে হল আমারই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ তার চোখে অশ্রু, স্বামী মাস্ক পরা পাশের বেডে৷ স্বামীর দিকে তৃপ্তির একটা চাহনি দিয়ে বলল- “স্বামী ছাড়া আমার জীবনের দাম কি?” ক্ষণিকের জন্য মনে হল- আমি কি শরৎ
বা রবীন্দ্র’র সংলাপ শুনছি কোনো!

নারায়ণগঞ্জের একজনকে পেলাম৷
এদের সবার অবস্থা উন্নতির দিকে৷ তাদের শোকের স্তরগুলো আর নেই। যেহেতু সুস্থতার দিকে, তাই মনটাও ভালো। মনোবল দৃঢ় রাখার জন্য প্রাসঙ্গিক কথাগুলো বললাম।
যা বলতে ভুলিনিঃ
কোভিড-১৯ এর রিকোভারি হিসেবে মানুষের মধ্যে এই কথাগুলো প্রচার করার আবেদন রাখলাম-
* স্বাস্থ্য বিধি ষোলো আনা মেনে চলা
* অহেতুক ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা
* গুজবে কান না দিয়ে যুক্তি দিয়ে যাচাই বাছাই করা
* ঘরে বসেই আত্মীয়স্বজনসহ অন্য মানুষের প্রতি দরদী আচরণ করা ও তাদের আর্থিক মানসিক সাহায্যে এগিয়ে আসা

এ কথায় সবাই সহাস্যে সায় দিয়েছে।
আমার আজকের এই উদ্যোগটা যেহেতু তাদের কাছে নতুন ও অভিনব কর্মকান্ড হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, রোগী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচক৷ তাদের হাসিখুশি মুখ দেখে আমিও তৃপ্তি পেলাম।

পিপিই, ফেস শিল্ড, সু কভার, গ্লাভস সব একটা নিদৃষ্ট রুমে ভিন্ন ভিন্ন বাস্কেটে রেখে লিফ্ট বেয়ে নিচে চলে এলাম।
ফিরতে ফিরতে গাড়িতেই অনেক কল পেলাম – কাজটা নাকি ঠিক হয়নি৷ হায়রে ভগবান!

আমি তো ভাবছি সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সাথে কথা বলে কিছু তরুণ সাইকিয়াট্রিস্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর সমন্বয়ে একটা টিম করে পিরিওডিক্যালি কোভিড হাসপাতালগুলোতে কাউন্সেলিং সেশন করব৷ সেবাপ্রদানকারী সেবাকর্মীদের সাথেও প্রোগ্রাম করব৷
মরার আগেই যেন কেউ না মরে সেটা দেখার দায়িত্ব মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের নেওয়া উচিত, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত৷

আমরা যেন এই মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রান পাই৷
আল্লাহ সহায় হউন৷ মানবিকতা বেঁচে থাক দীর্ঘদিন৷

(ঈষৎ পরিবর্তিত)

হৃদিতা রোশনী:
Related Post