X

“আমরা মুখ বন্ধ করে ভাঁড়দের যাত্রাপালা দেখছি”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ
শনিবার, ২রা মে, ২০২০

লেখা: ডা. নূর মোহাম্মদ শরীফ

স্বেচ্ছা নির্বাসনের চতুর্দশ দিবস আজ। কনিষ্ঠ কন্যা করোনা আক্রান্ত। বড়কন্যা এবং বৌ নেগেটিভ হলে ও ভয়ংকরভাবে এক্সপোজড। বাচ্চাদের এক রুমে বন্দী করে রাখা অমানবিক মনে হয়েছে। তাই পুরো বাসা ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে বাবা হিসেবে নিজেই নির্বাসনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নির্বাসনের মধ্যে জেলখানা জাতীয় একটা ভাব আছে। রুম থেকে বের হতে পারিনা। তবে খাবার সময় হলে প্লেট গ্লাস হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে শব্দ করলেই দরজার ফাঁক দিয়ে খাবার চলে আসে (নন টাচ টেকনিক 😋)। ফ্রি খাবারের পাশাপাশি কায়িক পরিশ্রমের অংশ হিসেবে কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা জাতীয় কাজগুলো নির্বাসনের অন্তর্ভুক্ত। এই সামান্য অত্যাচার সহ্য করতে পারলে নির্বাসন খুব একটা খারাপ বিষয় না। নির্বাসন শুরুর আগে বিশাল স্ক্রীনের এক টিভি কিনেছি। নেটফ্লিক্স, হৈ চৈ আর ও কি সব একাউন্ট ও করা আছে। নতুন পুরোনো বাংলা, ইংরেজি, হিন্দী রাজ্যের সব সিনেমা দেখে ফেলছি। লাইট অফ করে দিলে সিনেমা হলের মত লাগে। বিবাহিত জীবনে নির্ঝঞ্ঝাট টিভি দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যের আমার রুমে প্রবেশাধিকার না থাকায় এই অসাধ্য সম্ভব হয়েছে! একা থাকার আরো কিছু আনন্দ আছে। সকাল বেলা মশারি খুলতে হচ্ছেনা। বিছানা গোছানোর কোন ব্যাপার ও নেই। যখন খুশি ঘুম এবং যখন খুশি উঠতে পারছি। গভীর রাতে জোরে শব্দ করে টিভিও দেখা যাচ্ছে। মধ্যবয়সে এসে হোস্টেল জীবনে প্রত্যাবর্তন। হোস্টেলে থাকতে একবার ৬ মাস মশারি না খুলে ছিলাম। রুমমেট মাসুদের তুলনায় এটা অতি নগণ্য। ফার্স্ট ইয়ারে সে সাদা রংয়ের কভার সহ বালিশ দিয়ে হোস্টেল জীবন শুরু করে। একবারও না ধুয়ে তিন বছর পার করার পর থার্ড ইয়ারে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো বালিশের কভার ঘোর কৃষ্ণবর্ন ধারণ করেছে। ধুতে কষ্ট হবে এই ভেবে কভার ফেলে দিয়ে বাকি দুই বছর সে খোলা বালিশে শুয়ে কাটিয়ে দিলো! হাহহাহাহা….. কত শত গল্প যে আছে মেডিকেল জীবনের! লিখতে গিয়েও কখনো লেখা হয়নি। ব্যস্ত জীবন। জীবনের ব্যস্ততা। এই দুঃসময় পার হয়ে যদি বেঁচে থাকি, সব লিখে ফেলবো। মহাকাব্য হবে একটা হাহাহহাহ…..!

করোনা নিয়ে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়েছি। নিয়তি মেনে নেয়া ছাড়া করার কিছু নাই। আমাদের পরিবারে এর আগমন কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাত ধরে। হাসপাতালে রাউন্ডে পজিটিভ রোগী থেকে সম্ভবতঃ সে প্রথম আক্রান্ত হয়। তাকে দোষ দেইনা। সতর্ক থেকে কোন লাভ নেই। সারা বাংলাদেশে ৫০০ এর বেশি ডাক্তার আক্রান্ত। এমন সংবেদনশীল একটা সময়ে সরকারীভাবে মাস্ক নিয়ে কেলেংকারী। তরবারীর বিপরীতে আমাদের যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে কলাগাছ হাতে দিয়ে। সভ্য রাষ্ট্র হলে অবশ্যই মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। আমরা মুখ বন্ধ করে ভাঁড়দের যাত্রাপালা দেখছি! চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাই অবশ্যই আক্রান্ত হয়েছে অথবা হবে। আজ নাহয় কাল।

পরিবারের সংক্রমনের শুরুতে আতংকগ্রস্ত ছিলাম। আতংক কমানোর জন্য পড়াশুনা শুরু করলাম। ছবির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়াশুনা। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোতে কি অদ্ভুত একটা গন্ধ! বইগুলো হাতে নিতে মন ভাল হয়ে গেল। আমার কত নির্ঘুম রাত, কত সুখ দুঃখের সাথী এগুলো! বই লেখার কাজটা ও যতদূর পারি এগিয়ে নিয়ে যাই। কপাল খারাপ হলে তো মরেই যাবো। তার আগে যতটুকু পারা যায়! শতকরা ৮০ ভাগের কিছুই হবেনা। ১০-১৫ ভাগ অসুস্থ হবে, আই সি ইউ তে যাবে, কিন্তু সুস্থ হয়ে ফিরবে। ৫-১০ ভাগ মারা যাবে। শত চেষ্টাতে কিছু করা যাবেনা। দীর্ঘ ধূম্রপানে ফুসফুসের অবস্থা শোচনীয়। আক্রান্ত হলে শেষ ৫-১০ ভাগের মধ্যে থাকার সমূহ সম্ভাবনা! আতংক নিয়ে মারা যাবার কোন মানে হয়না। পরিতৃপ্তি নিয়ে মরতে চাই। কম সময় তো পার করলাম না পৃথিবীতে! অনেক বসন্ত দেখা হয়েছে, অনেক বর্ষা দেখা হয়েছে! অনেক অন্ধকার দেখা হয়েছে, অনেক জোছনা দেখা হয়েছে। পাহাড় দেখেছি, সমুদ্র দেখেছি, অরণ্য দেখেছি। ভালবাসা দেখেছি, অবহেলা দেখছি। অনেক মানুষও দেখা হয়েছে। একজীবনের প্রাপ্তি খুব তুচ্ছ করার মত না! বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। ভাল সুস্থ থাকুক সবাই! এ সময় শুধু বেঁচে থাকার সময়।

হৃদিতা রোশনী:
Related Post