সাংবাদিক ভাই, আপনারদের শরীরে কি মানুষের রক্ত?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন সহযোগী অধ্যাপকের স্ত্রী, কন্যা স্পিডবোট দূর্ঘটনায় মারা গেছেন, সেই চিকিৎসক এবং তাঁর সহকর্মী আরেকজন চিকিৎসক এখনো হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি আছেন। কিন্তু আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা নিউজ করলেন-“ভোলায় ডাক্তারদের সাপ্তাহিক হাট বাজার শেষ করে বরিশালে যাওয়ার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় ভোলা থেকে অবৈধ ভাবে কামানো দুই ডাক্তারের কাছে থাকা ২০ লক্ষ টাকাও নদীতে ভেসে যায় বলেও নিশ্চত করেছেন আমাদের ওই প্রতিনিধি(ভোলা নিউজ ডটকমের ভেদুরিয়া প্রতিনিধি মঞ্জুরুল আলম)”। শুধু নিউজই না, নিউজের মন্তব্যে সংবাদভাষ্যে বলা হলো, এই দূর্ঘটনা আল্লাহর গজব, ভোলার গরীব মানুষের কষ্টের টাকা এই চিকিৎসকেরা লুট করে নিয়ে যায়।

কতটুকু স্পর্ধা থেকে “ডাক্তারদের হাট বাজার” কথাটা একজন চিকিৎসকের স্ত্রী কন্যার মৃত্যু সংবাদের
সাথে লেখা যায়! কতটুকু আক্রোশ থেকে একই মৃত্যু সংবাদে চিকিৎসকের উপার্জনকে “ভোলা থেকে অবৈধ ভাবে কামানো…২০ লক্ষ টাকাও নদীতে ভেসে যায়” লেখা হয়! সাংবাদিক ভাই, আপনাদের গায়ে কি মানুষের রক্ত?

কথাগুলোর জবাব দিতে বা বিদ্বেষ ছড়াতে এই লেখা নয়, আসুন কিছু তথ্য জেনে নেই। ভোলা জেলার প্রতি ২০ লক্ষ ৩৭ হাজার লোকের জন্য মাত্র একজন সরকারী অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ আছেন(জেলা সদর হাসপাতালের জুনিয়র কন্সাল্টেন্টের একমাত্র পদটিও প্রায় সব সময় ফাঁকা থাকে)। সেই অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞও আবার এনেস্থেশিস্টের অভাবে কাগজে কলমে অকার্যকর(এনেস্থেশিয়া ছাড়া ছোটখাট কাজ ছাড়া অর্থোপেডিক চিকিৎসা অসম্ভব)। জেলার গত ১ বছরে সর্বোচ্চ প্রথম ৫ টি স্বাস্থ্য সমস্যার এবং মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ দূর্ঘটনা/আঘাত জনিত বা অর্থপেডিক সমস্যা। জেলায় অর্থপেডিক রোগীর চাহিদা এতই বেশি যে গত বাৎসরিক হেলথ বুলেটিনে সিভিল সার্জন ভোলা জেলায় একটি ট্রমা সেন্টারের সুপারিশ করেন। ২০(+২) জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে বর্তমানে ১০(+২) জন চিকিৎসক আছেন, সিভিল সার্জনের ভাষ্য ভোলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকতে চান না। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর মাঝে ৫-৭ জন অর্থোপেডিক প্র্যাকটিস করেন যার মাঝে কেউই ভোলার স্থানীয় নন, সবাই বরিশাল নয়ত ঢাকা থেকে আসেন।

এই যখন পরিস্থিতি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মানের একজন অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞ যখন তাঁর ঢাকার প্র্যাক্টিস ছেড়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্ত্রী কন্যাসহ নিজ গ্রামের মানুষের(এখানে স্ত্রীর হবে) চিকিৎসা করতে আসেন তখন তাঁর এই প্র্যাক্টিস(আমি বলবো সেবা)কে “হাট বাজার, অবৈধ উপায়ে কামানো” বলা হয় তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনার গায়ে কিসের রক্ত”?

কয়েকমাস আগে ঠিক একইভাবে ভোলা অঞ্চলের একমাত্র শিশু বিশেষজ্ঞ (আড়াই লাখ জনগোষ্ঠীর এক চতুর্থাংশ ৬০ হাজার অনুর্ধ ৫ বছর বয়সী শিশুর চিকিৎসক) কে ভুল চিকিৎসার অভিযোগে(ইঞ্জেকশন দিয়ে) একটি শিশুর মৃত্যুর পর পেটানো হয়, পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দিতে গ্রেফতার করে। অথচ শিশুদের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় এটি অপরীহার্য। আরো দশ বিশ বছর আগে, একই অঞ্চলে একজন নবীন চিকিৎসক প্র্যাক্টিস শুরু করেছিলেন। প্রেস্ক্রিপশনে টাইপ করা যার হাতের লেখা, তাঁকে একবার বাসায় কলে যেতে খুব চাপাচাপি করা হয়, হাতে থাকা রোগী শেষ করতে কিছুক্ষণ দেরি হওয়ায় তাঁকে অন কলে বাসায় নিয়ে গিয়ে রোগীর সামনে দরজা বন্ধ করে পেটানো হয়। তিনি সেই যে এলাকা ছাড়লেন আর কখনো ঐ এলাকায় জাননি, তিনি এই মূহুর্তে দেশ সেরা একজন ___স্পেশালিস্ট, তাঁর কাছে সিরিয়াল দিতে ৩ মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাঁর নিজ এলাকার মানুষ কিভাবে বঞ্চিত হলো? কেন?
সাংবাদিক ভাই, আপনার গায়ে কি মানুষের রক্ত? বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বছরে বাজেট কত সরকারের জানেন? ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে কত রোগী যায় জানেন? ৫ লাখ রোগী(২০১৫ সালের হিসেব), বছরে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, চীন মিলে কত হাজার বাংলাদেশী টাকা বিদেশে পাচার হয় জানেন? ২০ হাজার কোটি টাকার বেশী(একটি রিপোর্টে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার কোটি বলা হয়েছে)। পাচার কারণ একজন রোগী বৈধ ভাবে ৫০০ ডলারের বেশী নিয়ে যেতে পারে না, এর বাইরে বাকি সব টাকা অবৈধ উপায়ে(হুণ্ডি ও অন্যান্য) পাচার হয়। তাঁর মানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পকেটের পয়সায় ২১ হাজার স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, ৭০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী(সকল পর্যায়ের), ১৬ কোটি মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বিনামূল্যের ওষুধ, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সরঞ্জাম, ওয়ার্ডবয় থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা কিছুই পুষেন তাঁর চেয়ে বেশী টাকা শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য হাতে গোণা ৪-৫টি দেশ, সে দেশে যেতে তাঁদের ৩০০-৫০০ দালাল প্রতিষ্ঠান ও আরেকটি নির্দিষ্ট প্রজাতির পেটে যায়।

হ্যাঁ এই নির্দিষ্ট প্রজাতি সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে, বাংলাদেশের চিকিৎসক, হাসপাতালের উপর আস্থাহীন করে তোলে, চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীন করে তাঁদের সম্মানহানী করে। হ্যাঁ চিকিৎসকেরাও দোষী, কারণ তাঁদের নিজস্ব কোন আকার নেই, যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্র ধারণ করে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী তাঁদের প্যাড-কলম-বিদেশভ্রমণ দিয়ে কেনে, ক্লিনিক ব্যাবসায়ীরা রোগী ধরার দালাল-কমিশন-চালু চেম্বারে এসিরুম দিয়ে কেনে, সুবিধাবাদী নেতা ভালো পোস্টিং, প্রমোশন আর স্ট্যান্টবাজ মন্ত্রী ধমক আর শাসন দিয়ে কেনে। ওষুধ কোম্পানীর মালিকেরা ১টাকার ওষুধ ১০টাকায় বিক্রি করে তাতে দোষ হয় না, ক্লিনিকের মালিক ১টাকার পরীক্ষা ১০টাকায় করায় তাঁর দোষ হয় না, স্ট্যান্টবাজ মন্ত্রী জনগণ শুধু প্রেস্ক্রিপশন মানে রোগের ব্যবস্থাপত্র ফ্রির জায়গায় সব কিছু ফ্রি হবে বলে পাবলিককে উস্কায় দিয়ে নিজেরা সিঙ্গাপুর ব্যাংককে হোল বডি চেক আপ করায় তাতে দোষ হয় না, একজন চিকিৎসক নিজ গ্রামে, নিজের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা বিসর্জন দিয়ে স্ত্রী কন্যা সহ সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে গেলে সাংবাদিক ভাইদের রক্তে ২০ হাজার কোটি টাকার দালালীর পারসেন্টেজ টগবগ করে ফুটতে থাকে। যেহেতু ওস্তাদে বলছে চিকিৎসা ফ্রি, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ সরকারি হাসপাতালে যায় ফ্রিতে ওষুধ নিতে আর আসল অসুখে যায় প্রাইভেট ক্লিনিক আর এপলো ইউনাইটেড স্কয়ারে তখন আর তাঁদের সামর্থ্যে আর ক্ষমতায় কুলায় নায়।

নেতা-ক্লিনিক মালিক-ফার্মার মালিক-জনগণের ফ্রি চিকিৎসার আকাঙ্ক্ষার পাপে চিকিৎসক কসাই হয়ে যায়। আসুন এক সত্যিকার কসাইয়ের ভিডিও দেখি, এই কসাই গতকাল রাতে একজন রোগীকে মাত্র তিন মিনিট দেরি করে দেখায় একজন দেবতারূপী রোগীর ছোঁয়া পেলেন, হ্যাঁ চিকিৎসক তখনো আরেকজন অতিজরুরি রোগী দেখছিলেন(রোগীর নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল যাকে আগে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে), এবং ঘটনা ঘটে রাত দশটা ২২ মিনিটে, তিনি সকাল ৯টা পর্যন্ত ঐ একই ইমার্জেন্সিতে ডিউটি করেছেন বিনা দ্বিধায়।

সাংবাদিক ভাই আপনার গায়ে কি মানুষের রক্ত?

দালাল, রাজাকার, বেজন্মা শব্দগুলো অভিধান থেকে মুছে দেয়া হোক।

( হ্যাঁ লোকাল পত্রিকার নিউজ বলে বিগশট সাংবাদিক ভাইয়েরা এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু বিগ শটরাও এই সমাজের বাইরে না, যেমন কমিশন খাওয়া চিকিৎসকরাও আমাদের পেশার বাইরে না, ঐ পত্রিকার সম্পাদকের নাম, প্রতিবেদকের নাম, ওয়েব সাইট সব কিছুই আছে, শুধু চিকিৎসকদের নামগুলো এখানে নাই লিখলাম)।

Posted by মোহিব নীরব on Thursday, December 29, 2016

Posted by মোহিব নীরব on Thursday, December 29, 2016

লেখক ঃ ডাঃ মোহিব নীরব, প্রতিষ্ঠাতা, প্ল্যাটফর্ম

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

8 thoughts on “সাংবাদিক ভাই, আপনারদের শরীরে কি মানুষের রক্ত?

  1. Vai ak din akdin matro amra sobai ak hoe shikkha dite pari na cholen akdin emergency off rakhi sara Bangladesh er jani parbo na karon amader namer age sei mohanuvob Shobdo ta ace DR. ora sob kicu parleo amra kicui parbo na

  2. লিখাটা দারুণ! তবে এই সাংবাদিকের পূর্ণ পরিচয় সবার সামনে উন্মোচিত করে এর যথোপযুক্ত #শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ।

  3. কিছুদিন আগে, নোয়াখালিতে এক হাসপাতালে ডিউটি ডক্টর থাকা অবস্হায়, এক পেশেন্ট এর টোটাল থাইরয়েডেকটমী হয়। রোগী পূর্ণ রিভার্স করে।

    বাট, সকালের দিকে, রোগীর BP হঠাৎ করে Nill হয়ে যায়। Dopamine, ITT, Cotson, Adrenaline, CPR দিয়ে ও রোগী রিভার্স করে নি। যাহোক, পার্টি ম্যানেজ করা হয়েছে।

    এক দিন পরে শুনি, পত্রিকা গুলোতে এসেছে, অমুক হসপিটালে টনসিল অপারেশনের পর ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু। এমনকি যগান্তর, নয়াদিগন্তে ও এমন নিউজ আসছে। মন চাইসিলা ঠুন্ডা ঝাড়ু দিয়া, কুকুরের মত দৌড়াইতে দৌড়াইতে, সাম্বাদিকদের পিটাই।

    পরে, সিভিল সার্জন সহ, পুলিশ এসে তদন্ত করেও কোনো ফল্ট পায়নি। এমন সাম্বাদিক দের কি করা উচিত বলেন তো?? অমানুষের বাচ্চা সব। টোটাল থাইরয়েডকে টনসিল বানায়, জানোয়ারগুলো।।

  4. হাম্বাদিকদের গায়ে মানুষের চামড়া দিলেও ওরা হাম্বা হাম্বাই করবে।।। আবাল এক প্রজাতি।।। চিড়িয়াখানায় খাচায় দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।।।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ফিরে দেখা একাত্তর : একদল চিকিৎসাকর্মী ও একঝাঁক শরণার্থীর কথা

Fri Dec 30 , 2016
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সীমান্তবর্তী ত্রিপুরার চিকিৎসাকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। রাজ্য সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল, প্রশাসন এমনকি তৃণমূল মানুষও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ত্রিপুরার চিকিৎসক, নার্স, কম্পাউন্ডার, স্বাস্থ্য সহকারীসহ সকল চিকিৎসাকর্মী, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেদিন সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। এই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo