বৃহস্পতিবারের চিঠি ২

(১)
যে স্টুডেন্ট শুধু মাত্র একটা এক্সাম এর জন্য নামের শুরুতে বহু আকাঙ্ক্ষিত ডাক্তার শব্দটা লাগাতে পারছে না, ফাইনাল প্রফের আগে তার মানসিক অবস্থাটা কেমন হয় সেটা আমি ভালোই ফিল করতে পারি। আর যারা অল্পের জন্য বার বার ফেল করে যাচ্ছো তাদের কেমন লাগে সেটাও আমি অনুভব করতে পারি।

আমার ইনবক্সে একদিন দেখলাম একজন জানিয়েছে, সে পড়তে পারছে না। তার পারিবারিক চাপ অনেক। তাকে যেন একটু হেল্প করি। ভীষন কষ্ট হয়, আমাদের পারিপার্শ্বিকতা যখন একজন পিছিয়ে পড়া স্টুডেন্ট এর সাথে বিমাতা সুলভ আচরন করে। কত কষ্ট হলে একজন মানুষ কারো সাহায্য চায়? তার কোন বন্ধু কি একটু এগিয়ে আসতে পারলো না? এটাই হয়তো নিয়তি। দিনশেষে আমরা সবাই স্বার্থপর।

shutterstock_55347913

 

একটা মেয়ে মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ারে এসে কনসিভ করে প্রফের আগে মা হয়ে পুরো বিপদে পড়ে গেলো। মেয়েটার একদিকে বাচ্চা নিয়ে টানাটানি, অন্যদিকে সংসার এর ঝামেলা আর নিজের শারীরিক দুর্বলতা। এগুলো ম্যানেজ করে কি আদৌ পড়া যায়? কিন্তু আমাদের অতি জ্ঞানীরা এইখানে হাজারটা যুক্তি দেখাবে। কেন বাচ্চা নিলা, প্ল্যানিং এ ভুল ব্লা, ব্লা! যা হয়ে গেছে তা নিয়ে তেনা না প্যাঁচিয়ে কিভাবে মেয়েটার পড়াশোনায় হেল্প করবে সেই চিন্তা কারো নাই। কাজের সময় সবাই হাওয়া। আমরা এমনই।

(২)

একটা ছেলে মা / বাবার অসুস্থতা কিংবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপের পর কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে গেলো, কেন তাকে সেই পিছিয়ে পড়ার জের নিজের জীবন দিয়ে দিতে হবে? ওই হারিয়ে যাওয়া সময়ের মাসুল দিতে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে তার এক্সাম দেয়া হয় না, সে ক্লিয়ারেন্স পায় না, কিভাবে কিভাবে যেন সে ডিফল্ডার হয়ে যায়। এক্সামে বসলেও তারদিকে আঁড় চোখে তাকানো হয়। লজ্জায়, ঘৃণায় আর অপমানে ছেলেটা এক্সাম হল থেকে বেরিয়েই ঠিক করে তার দ্বারা আর পাশ হবে না, লজ্জা পাওয়ার চেয়ে এক্সাম না দেয়াই উত্তম। ছেলেটা আরো পেছাতে থেকে। ভয় বাড়তে বাড়তে এক্সাম ফোবিয়া তাকে পেয়ে বসে। এই বৃত্ত থেকে সে আর বেরুতে পারে না।

কি অবাক ব্যপার, সেই সময়েই তার বন্ধুরা হোস্টেলে বিভিন্ন রুমে নিজেদের পড়াশোনা ডিসকাস করে। কম জানাকে টেনে তোলার দায়িত্ব কে নেবে? কার এত ঠ্যাকা?

(৩)

স্যার যখন না পারার জন্য আইটেম থেকে ছেলেটাকে উঠিয়ে দেন, কিম্বা মেয়েটাকে একটু বেশীই অপমান করেন তখন, স্যার কি একবারও ভাবেন এই ছেলে মেয়ের মুক্তির পথ কি?
যদি ভাবেন, ছাত্র ছাত্রীকে অধিকার নিয়ে ধমক দেন তাহলে এই রকম শিক্ষকই আমরা চাই। যে ছাত্র ছাত্রী এত ভালো ফলফল করে মেডিকেলে ঢোকে, এই নাজুক সময় গুলোতে তার একটু বেশী মানসিক সাপোর্টই দরকার হয়, এর বেশী কিছু না।

একজন শিক্ষক যখন তার পিছিয়ে পড়া ছাত্রটাকে নরম গলায় আদর করে নাম ধরে ডাকেন আমার মনে হয় ওই ছেলে বা মেয়ে তখনই প্রতীজ্ঞা করে যে আজ থেকেই সে পড়তে বসবে। এমন শ্রদ্ধেয় স্যারকে কষ্ট দেয়ার কথা বোধকরি কোন শিক্ষার্থীই কল্পনা করে না। আমার কাছে মা বাবার হাসির মতোই আমার শিক্ষকের হাসির দামও অনেক। শিক্ষকের মায়া যদি একবার কোন শিক্ষার্থীকে ছুঁয়ে যায় তো সে শিক্ষার্থীর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না।

পরিবেশ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক সবাই এগিয়ে আসলে এই ড্রপ আউট শব্দটাই মেডিকেল থেকে আউট হয়ে যায়।

তবুও কিছু অতি অভিমানী স্টুডেন্ট হয়তো থেকেই যায়, যাদেরকে কাউন্সেলিং করা আসলেই কঠিন। এদেরকে ভালোবাসার অধিকারে ধমক দেয়া যায় না, এদেরকে কিছু বলা যায় না, এরা কাউকে বিশ্বাস করে নিজের দুর্বলতার কথা প্রকাশও করে না। অজুহাত আর অজুহাত দিতে থাকা এই স্টুডেন্টদের ফিরে আসা আসলেই অনেক শ্রমসাধ্য ব্যাপার।

(৪)

ফাইনাল প্রফ নিয়ে বলছি এবার। এক্সাম ফোবিয়া বাদ দাও। প্রতীজ্ঞা করো এখন থেকেই তুমি সিরিয়াস। বিশ্বাস রাখো এই মুহূর্ত থেকে তুমি সিরিয়াস হলে তোমার পাশ করার লক্ষ্যে তুমি অনেক দূরে এগিয়ে গেলে। বিশ্বাস করো এক্সাম শেষ হলেই তুমি পাশ করে ডাক্তার হয়ে যাচ্ছো। স্বপ্ন দেখো, নিজের মুখেই হাসি ফুটবো, আহ কি শান্তি তাই না? একটা কাগজ নাও লিখো, কত দিন বাকি আছে, ডেইট গুলো একদিন একদিন করে কাটবে, কত ঘন্টা পড়লে কি পড়লে সেটা পাশেই লেখা থাকবে। কম বা বেশী যাই পড়া হবে তুমি নিজেই বুঝবে। সো, কনসিস্ট্যান্ট কম পড়লে পাশ হবে না, এটা তুমি এক্সামের আগে তোমার এই দাগানো কাগজ দেখেই বুঝে নেবে। ডিপ্রেশানের সুযোগ কোথায়?

এবার আসো পড়াশোনা কিভাবে করবে। মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী অবস অনেক বড়। ওকে ফাইন। অন্য ভাবে ভাবো। যেহেতু তোমার হাতে সময় কম তুমি ট্যাকনিকেল হও। এক্সাম অরিয়েন্টেড প্রিপারেশান নাও।

রিটেনে প্রিভিয়াস ইয়ারের কোয়েশ্চান সলভ।
লং কেইস সিলেক্টেড ১৫-২০ টা এ টু জেড।
শর্ট কেইস সেইম ১৫-২০ টা এ টু জেড।
কিভাবে হিস্ট্রি লিখবা সেই একটা প্রোফর্মা আগে থেকে রেডি করো। এই রিলেটেড এক্সামিনেশান বার বার প্র‍্যাক্টিস করো। স্যাররা কি কি কমন কোয়েশ্চান করেন সেইগুলো নিয়ে একটু ভাবো। খুব বেশী টাইম লাগবে না কিন্ত।

বি কনফিডেন্ট। তুমি যা পড়বা তা এক্সামে আসলে তোমাকে পারতেই হবে, সো বী কেয়ারফুল। পারি না পারি না বলে এর কাছে ওর কাছে অহেতুক সমবেদনা চাওয়ার মতো লজ্জার আর কিছু নেই। নিজেকে কেন ছোট করবে?

আমরা বড় ভাই, সিনিয়র, স্যার দের পিছনে কিছু জানার জন্য ঘুরি ঠিক আছে বাট সময় নষ্ট না করে বই খুলে দুইবার পড়লে আমরাও কিন্তু বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝে ফেলবো। সো সেল্ফ হেল্প ইজ দ্যা বেস্ট হেল্প।

(৫)

ফাইনাল প্রফের এক্সাম টেবিল, কেইস প্রেজেন্টেশান, এক্সামিনেশান, রিটেন কোয়েশ্চান সব কল্পনায় দেখতে থাকো দেখবে তোমার মাইন্ড ধীরে ধীরে লোড নেবার উপযোগী হয়ে উঠবে। দেখবে তোমার আস্তে আস্তে পড়া মনেও থাকছে।

এখন নিজে নিজে রিটেন এর সাজেশান বানাও। সব কিছুর একটা জিস্ট করো। এরপরও না পারলে পরের বার পারবে। পারতেই হবে এমন একটা জেদ না থাকলে পরীক্ষা দেয়াটাই বৃথা। আমি সবসময়ই বলি, এক্সাম সিরিয়াসলি পাশ করার উদ্দেশ্যেই দিতে হবে।

মেডিকেলে কোন টপিকস মনে রাখতে গেলে ওই রিলেটেড পেশেন্ট দেখতে হয়। এক্সরে, ইসিজি, ইন্সট্রুমেন্ট এই গুলো বইতে ভালোই আছে কারো কাছেই যাওয়া লাগে না। প্লিজ একটু বিশ্বাস করো, নিজে নিজে দুই তিনবার পড়েই দেখো, অবশ্যই পারবে ।

ওয়ার্ডের পেশান্ট, ওটির প্রসিডিওর এসব পড়ার সময় ওয়ার্ডের কথা মনে করবে, কল্পনা করতে না পারলে একটু ওয়ার্ডে ঘুরে আসলেই পারো। আগ্রহ বাড়বে, পড়াটাও মনে থাকবে।

স্বপ্ন যখন দেখছো, ভালো করেই দেখো। নিজের আত্মসম্মানকে নিজের হাতেই বাঁচিয়ে রাখো। তুমি নিজেই তোমার বড় শিক্ষক। ভুল থেকে শিক্ষা নাও, একাধিক বিষয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত এক্সাম পাশের চিন্তা করো। প্লিজ, অহেতুক টেনশান, ডিপ্রেশানে সময় নষ্ট করলে তোমারই ক্ষতি, রেজাল্ট যাই আসুক, পজিটিভ চেষ্টাটাই আসল, সবাই যখন পারে, তুমিও পারবে।

প্লিজ, দেখিয়ে দাও, ফিরে এসো, সবাইকে পেছনে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাও।
show-the-world-your-magic-mati-rose-studio-570

 

লিখেছেন ঃ ডাঃ মৃণাল সাহা, প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং চিফ

{ লেখাটি আপনারা ওয়েবের মাধ্যমে শেয়ার করবেন। প্ল্যাটফর্ম কতৃপক্ষ এর অনুমতি ছাড়া লেখাটা কপি করা যাবে না।}

প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং এর ব্যপারে আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে কিংবা কোন রকম কাউন্সিলিং সাহায্য এর প্রয়োজন হলে ,[email protected] এই মেইল এড্রেস  এ মেইল করুন। যদি চান আপনার নাম পরিচয় অপ্রকাশিত থাকবে।

আগামি বৃহস্পতিবার আবার  ৩য় পর্বের অপেক্ষায় থাকুন আর এই পর্ব নিয়ে আপনাদের মুল্যবান মতামত জানাবেন।

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সৃষ্টিকর্তার পর কেবল ডাক্তারই পারেন, আস্থা রাখুন

Sun Nov 20 , 2016
বোমায় আহত মাইয়েশার ইমার্জেন্সি সিজার করা হলো। ডান হাত, ডান পায়ে ফ্র‍্যাকচার, পেটে বোমার স্প্লিন্টার বিধেঁ রক্তাক্ত। চিকিৎসকেরা মনে করেছিলেন তাঁর গর্ভের সন্তান বেঁচে নেই। তবুও রক্তে ভেসে যাওয়া তলপেট থেকে মাইয়েশার সন্তানকে বের করে আনলেন চিকিৎসকেরা। কান্নাহীন নবজাতকের তাকিয়ে সহকর্মীকে একজন চিকিৎসক জানতে চাইলেন: হৃদস্পন্দন আছে? নিঃস্পৃহ উত্তর: দুঃখিত, […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo